শ্রেণী-সংগ্রামের প্রাচীনতম দলিল
যে দিন থেকে সমাজে শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, তখন থেকে শ্রেণী সংগ্রামও অব্যাহত গতিতে চলে আসছে। শ্রেণী-সমাজ কখনোই কোনো অবস্থাতেই শ্রেণী-সংগ্রাম থেকে ম্ক্তু থাকতে পারে না। তবে তা কখনও তীব্র ও ব্যাপক, কখনও মৃদু ও সীমাবদ্ধ, কখনও সরল, কখনও জটিল, কখনও প্রকাশ্য, কখনওবা প্রচ্ছন্নভাবে আবর্তিত হয়ে চলে। এই শ্রেণী-সংগ্রামের টানা-পোড়েনের মধ্যে দিয়ে মানব সমাজের ইতিহাস রচিত হয়ে চলেছে।
আমাদের এ দেশে এমন লোক এখনও আছে যারা শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে-বিজাতীয় ভাবধারার গন্ধ পায় এবং অবজ্ঞা ভরে নাক সিঁটকায়। ইতিহাসের গতিধারা সম্পর্কে বেচারারা একেবারেই অজ্ঞ। আর আমরা-আমরাই কি পুরোপুরি সচেতন? মানব সমাজে শ্রেণীর উদ্ভবের পর থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে মহাসমুদ্রের বুকে সংখ্যাহীন তরংগের মতো শ্রেণীতে শ্রেনীতে কত সংঘর্ষ, কত হানাহানি মানব সভ্যতার প্রবাহকে চঞ্চল ও গতিশীল করে তুলেছে, তার কতটুকু হিসাবই-বা আমরা রাখি! আজও আমাদের চোখের সামনে অহরহ যা ঘটে চলেছে, তাদের তাৎপর্য ও পরিণতি বোঝা দূরে থাক, অনেক সময় আমরা তা দেখেও দেখি না।
ঐতিহাসিক যুগে পদার্পণ করবার পর শ্রেণী-সংগ্রামের প্রাচীনতম দলিল দেখতে পাই প্রাচীন মিসরের ইতিহাসে। এই দলিল এক দীর্ঘকাল স্থায়ী শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস বহন করছে। এর সূচনা সম্ভবতঃ খৃষ্টপূর্ব ২৩৫০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৪৩১৮ বছর আগে এবং অবসান খৃষ্টপূর্ব ২১৫০ সালে। দীর্ঘ দুশো বছরের রক্তাক্ত শ্রেণী-সংগ্রামের কাহিনি। প্যাপিরাস-এর পাতে লিখিত সেই কাহিনির মধ্য দিয়ে আমরা সেই যুগের মিসরের শ্রেণী নির্যাতন ও শ্রেণী-সংগ্রামের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে পাই।
শুধু মিসর নয়, প্রাচীন জগতে লিখন শিল্প ছিল লিপিকারদের (Scribe) একচেটিয়া ব্যাপার, এটা ছিল সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে। অন্যান্য বহু অধিকারের মতো তারা এই অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল।
প্রাচীন মিসরের কৃষকদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক লিপিকার লিখছেন: ‘ক্ষেতের আধা ফসল খেয়ে ফেলেছে পোকায়, কিছু গেছে হিপ্পোপোটেমাসের পেটে। ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের দঙ্গল, পঙ্গপালের দলও এসে পড়েছে, গরু বাছুর ফসলের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে, চড়ুইর দল ফসল চুরি করে খায়, গোলায় যা কিছু সঞ্চিত ছিল তাও গিয়ে পড়ে চোরদের হাতে। লাঙ্গল চষতে চষতে আর ফসল মাড়াই করতে করতে বলদগুলি অতিরিক্ত পরিশ্রমে মারা যায়। এরপর সরকারের লোকরা আসে তাদের প্রাপ্য ফসল আদায় করে নিতে। হায়রে চাষী! সরকারী কর্মচারীদের হাতে ছড়ি, সাথে তাদের নিগ্রো অনুচর, হাতে তাদের ভাণ্ড। তাদের দেরী সয় না, হেঁকে উঠে, দে, দিয়ে দে আমাদের পাওয়া ফসল। যে কৃষকদের কাছে ফসল নাই, তাদের ধরে তারা বেদম প্রহার করে। শুধু কি তাই? তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা খালের পানিতে ফেলে দেয়, আর তারা ডুবতে থাকে। এই ভাবে তারা তাদের বউদেরও বাঁধে, ছেলে মেয়েদেরও বাঁধে।
রাজকর্মচারীরা নদীর পারে এসে নৌকা ভিড়ায়, গ্রামে গ্রামে গিয়ে লোকদের মধ্যে প্রচার করে চলে: ‘ফ্যারাও, (মিসরের রাজা) আর তার দলবল কিছু বাদেই এই পথ দিয়ে যাবেন, সেই জন্য সবাই যার যার নজর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাক তোরা।’ কি কি জিনিস দিয়ে নজর দিতে হবে, সেই ফিরিস্তিটাও তারা ঘোষণা করে দেয়: পাঁচ রকমের ১৫০০ উৎকৃষ্ট রুটি, ১৪২০০ অন্যান্য রুটি, ২০০০ পিঠা, ৭০টি কলসি ও ২০০০ অন্যান্য পাত্র, শুকনো গোশতের ১০০০ ঝুড়ি, ৬০ ভাঁড় দুধ, ৯০ ভাড় ননী, রান্না করবার জ্বালানি কাঠ, ডুমুর ও আঙ্গুরের ঝুড়ি এবং মেজ সাজবার জন্য ফুল ও ফলের মালা।
লিপিকারের উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বিপন্ন কৃষকদের প্রতি তাঁর মনের সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।
যেই মজুররা ফ্যারাও রামেসিস-এর মৃতের শহর (City of the dead) গড়ে তুলেছিল, তারা ধর্মঘট করে তাদের খাদ্য সরবরাহের দাবী আদায় করতে পেরেছিল। সরকারী দলিল-পত্রে এই ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করা আছে। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রথমে তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। ক্ষুধাক্লিষ্ট লোকগুলো এবার চেঁচামেচি শুরু করে দিল: ‘আমরা আঠারো দিন ধরে না খেয়ে আছি। আমাদের না আছে রুটি, না আছে মাছ, না তরকারি। আমরা বলে দিচ্ছি, হ্যাঁ জানিয়ে দিচ্ছি, ফ্যারাও-এর রাজ্যে এবার দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে।’
এইভাবে আন্দোলন করে এই সমস্ত মজুর সরকারী কর্মচারীদের হাত থেকে মাসে ৫০ বস্তা করে ফসল আদায় করতে পেরেছিল।
এমন অবস্থা হলো কেনো? দেশে কি আকাল পড়েছিল? অজন্মা হয়েছিল? না মোটেই তা নয়। ঠিক একই সময় সেই একই সরকার কেবল থিবনগরের পুরোহিতদের জন্য বছরে ১০,০০০ বস্তা ফসল জুগিয়ে চলছিল। সে বিষয়ে কোনো ত্রুটি ছিল না। ফ্যারাও তাঁর এক রাণীর নামে একটা পুরো জেলা লিখে দিয়ে ছিলেন। এই জেলার মোট ফসল বাবত যে রাজস্ব পাওয়া যেতো, তা তার সেই আদরিণী রাণীর জুতো কেনার জন্য ব্যয় করা হতো। এনটাইলেন অঞ্চলে যে মদ উৎপন্ন হতো, তার রাজস্ব দিয়ে তার আর এক রাণীর কোমরবন্ধ ও গায়ের জামা কেনা হতো।
শ্রমজীবী জনসাধারণের অবস্থা বর্ণনা করে আর একজন লিপিকার লিখেছেন: ‘দেখলাম কামার তার হাপরের সামনে বসে কাজ করছে। তার আঙ্গুলগুলি কুমীরের আঙ্গুলের মতো হয়ে গেছে। সারাদিন কাজ করেও তার বিশ্রাম নেই, রাত্রিতেও কাজ করতে হয়। তার শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে চায় না, তবুও তাকে কাজ করতে হয়। যেই কারিগর পাথর খোদাইর কাজ করে, সে তার হাতের কাজ শেষ হওয়া মাত্র ওই পাথরের ধারেই অবসন্ন হয়ে পড়ে থাকে। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে কিন্তু নাপিত তখনও ব্যস্ত, তখনও সে খদ্দেরের আশায় ছুটোছুটি করে বেড়ায়। পেট ভরাতে গিয়ে তার হাতের আঙ্গুলগুলি হাডডিসার হয়ে গেছে। নৌকার মাঝি মাল চলাচল করতে করতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে; তার উপর দুরন্ত মাছিগুলি হুল ফুঁটিয়ে তার পরমায়ু নিঃশেষ করে আনে। তাঁতীর অবস্থা ঘরের মেয়েদের চেয়েও খারাপ। পেটের উপর হাঁটুর চাপ দিয়ে সে উবু হয়ে বসে কাজ করে চলে। ভালো করে দম ফেলতেও পারে না। বার্তাবাহকেরা তাদের কাজে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় তাদের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যায়, কেননা পথে সিংহ আর এশিয়ার দুর্দান্ত লুণ্ঠনকারীদের ভয়, জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। মুচী সারাদিন নিজের অদৃষ্টের অভিশাপ দেয়। ধোপা নদীর তীরে কাপড় সাফ করে শুকোতে দেয়, কিন্তু কুমীর তার নিকট প্রতিবেশী, তার সঙ্গে তাকে মোকাবিলা করে চলতে হয়। জেলেদের অবস্থা আরও খারাপ, কুমীরের ভয় তাদের আরও বেশী।’
এই অবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছিল, কিন্তু মিসরের দুর্গত কৃষক আর শ্রমিকেরা একদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। বহুযুগের সঞ্চিত বিক্ষোভ অগ্নিগিরির মতো ফেটে বেরিয়ে এলো। এই অভ্যুত্থানের ফলে দেশে ধনীরা আর পুরোহিত সম্প্রদায় তাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি হারালো। এই বিপ্লব দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। যতদূর অনুমান করা গেছে, খৃষ্টপূর্ব ২৩৫০ থেকে ২১৫০ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বর্তমান ছিল।
কিন্তু এই বিপ্লবের ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে, মিসরের সেই নির্যাতিত জনসাধারণ, যারা সেদিন বিজয় লাভ করেছিল, তাদের পক্ষের কোনো বক্তব্য লিপির মারফৎ আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। এর কারণটাও সুস্পষ্ট। মিসরের সেই সময়ের ধর্মীয় লিপি ছিল পুরোহিতদের একান্তভাবে একচেটিয়া। সাধারণের পক্ষে তার ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। এই রক্তাক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হানাহানির ফলে সমাজের বুকে যে মহাতাণ্ডবের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকু আমরা বিজিত শ্রেণীর কাছ থেকেই পেয়েছি। লিপির হাতিয়ার থেকে বঞ্চিত নির্যাতিত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ যেমন তার নিজের ভাষায় তার
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments