এটম বোম
শেয়ালনী, ও শেয়ালনী, আঃ হা, কোথায় গেলে তুমি? শেয়াল গর্তে ঢুকেই হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে।
শেয়ালনী তার ছানাগুলোকে আদর করছিল। শেয়ালের এত হাঁকডাক শুনে আর বসে থাকতে পারল না। ওদের কোনো রকমে ঠেলে-ঠুলে সরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ছুটে এলো। কিন্তু সব চেয়ে ছোটটা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত, নাছোড়বান্দা। সে মায়ের ঘাড়ে শক্ত করে কামড়ে ধরে ঝুলতে ঝুলতে আর হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে চলে এলো।
মা বাচ্চাটার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বলল, দেখেছ, পাজির কাণ্ডটা।
শেয়াল বলল, ব্যাটা এক নম্বরের বদমাইশ হবে।
হ্যাঁ, বাপের মতোই হবে। কিন্তু আমাকে অমন করে ডাকছিলে কেন গো তুমি? হয়েছে কি? শেয়ালনী জিগ্যেস করল।
মা-বাপের মন! বাচ্চাটাকে দেখে শেয়াল তার আসল কথাটাই ভুলে গিয়েছিল। অথচ এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই ছুটে এসেছে। শেয়ালনীকে না বলা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
বিষম কাণ্ড। লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। তুমি তো কিছুই খবর রাখ না, ওদিকে যে কত কি সব হতে চলেছে। তুমি তো ঘরের কোণে বসে দিন কাটাও। দিন দিন এক্কেবারে মেয়েমানুষদের মতো হয়ে যাচ্ছ।
শেয়ালনী শেয়ালের কথায় দস্তুরমতো চটে উঠল, তোমার কি, তুমি তো বাপ হয়ে খালাস। আর এই চারটেকে নিয়ে যত ভোগ-ভোগান্তি সব আমার কপালে। দিনরাত্তির এই শত্তুরগুলো আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমার মরবার সময় নেই, আমি বাইরে যাই কখন? তুমি আবার এর উপর ফোঁড়ন দিতে এসো না।
শেয়াল বুঝল, কথাটা খারাপই হয়ে গেছে। শেয়ালনীকে ঠান্ডা করবার জন্য সে তার সারা গায়ে তার লেজটা বুলিয়ে দিয়ে বলল, আহা, অত রাগ কর কেন? আমি বললাম একটা কথার কথা। সব কথা কি অমন করে গায়ে মাখতে আছে? আরে তুমি-যে ‘বাপ’ বলে আমার উপর ঠেস দিয়ে কথা বলছ। আমি কি করব, বল? আমি কি ওদের পালতে পারি? সেই ক্ষমতা কি আমার আছে?
শেয়ালনী খুব রাগ করেছিল কিনা, তাই মুখখানা বিষম গম্ভীর করে ছিল। কিন্তু শেয়ালের কথাটা শুনে আর থাকতে পারল না, ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, থাক, আর অত কথার কাজ নেই। তুমি তো শেয়ালপণ্ডিত, কথার সাগর, তোমার সঙ্গে কি আমি কথায় পারব? এখন কি বলছিলে, তাই বল। এসেই কি হাঁকডাক—ভাবলাম প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেল বুঝি।
আরে মহা মজার ব্যাপার—যুদ্ধ লাগবে শেয়ালনী—যুদ্ধ।
যুদ্ধ? কাদের যুদ্ধ গো? তুমি কিন্তু ওসবের মধ্যে থাকতে পারবে না আগেই বলে রাখছি। তোমার কি, একটা হুজুক পেলেই হলো। মস্ত বীরপুুরুষ তো!
আরে পাগল, আমার কোন কাম যুদ্ধে গিয়ে? মানুষে মানুষে যুদ্ধ।
আহা, এ আবার একটা নতুন কথা কি? ওরা তো সব সময়ই যুদ্ধ করছে। ওরা কি যুদ্ধ ছাড়া থাকতে পারে নাকি? যার যেমন স্বভাব।
আরে, না না, তা নয়, সে যুদ্ধ নয়। এতদিন যুদ্ধ গেছে শুধু ফাট ফুট। এবার তা নয়। এবার এটম বোমা দিয়ে যুদ্ধ। এবার আর কারো রক্ষা নেই।
এটম বোমা কি গো?
এটম বোমা? হায়রে কপাল, তাও জানো না? এ এক বিষম অস্তর। অনেক মাথা খাটিয়ে বার করেছে মানুষ। এই অস্তর দু’পক্ষে দু’পক্ষের দিক তাক করে ছাড়বে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সব খতম। একটি মানুষও বেঁচে থাকবে না।
এমন বুদ্ধি না হলে শেয়ালপণ্ডিত বলবে কেন? কার মুখে কি শোন, আর তাই শুনে আন্দাজে-মান্দাজে লাফাও। সব মানুষ মরতে যাবে কিসের জন্য? যদি মরেই, যারা যুদ্ধে যাবে তারা মরবে। যারা ঘরে বসে থাকতে তাদের কি?
আরে বাবা, এ তেমনি অস্তর কিনা। এ-যে ঘরবাড়িশুদ্ধ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। যার নাম এটম বোমা।
তাই যদি হয়, তবে আমরা শুদ্ধ তো মরব।
না না, আমরা মরব কেন? আমরা থাকব জঙ্গলে আর মাটির তলায়!
মানুষ বড় হিসাবী গো, আমাদের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্য তারা এত দামী জিনিস খরচ করবে না। মানুষ লেগেছে মানুষের পিছে। সব মানুষ খতম না করে ওদের শান্তি নেই। সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতি কিনা।
তুমিও এক পাগল, আর যে তোমাকে এই খবর দিয়েছে সেও আর এক পাগল। একি কখনও হতে পারে নাকি? জেনে শুনে কেউ কখনও এমন কাজ করে?
করে গো, করে। এই দুনিয়াটা একটা আজব চিড়িয়াখানা। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি, শোন নি এ কথা?
আচ্ছা, তাই যেন হলো, তোমারই বা তাতে এত ফূর্তি কেন?
বারে বা, ফুর্তি হবে না? জানো শেয়ালনী, একদিন এই পৃথিবীটা আমাদের পশুদের রাজত্ব ছিল। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছিল শুধু বন আর বন। চার পেয়ে পশুরা তার মধ্যে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত। তখন মানুষ কোথায়? মানুষ তো সেদিনের ছেলে। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল। এসেই কথা নেই বার্তা নেই বন কেটে আবাদ করে গ্রাম আর শহর বন্দর বানাল। শুধু কি তাই, পশুদের ধরে বেঁধে পোষ মানিয়ে চাকরের কাজ করাতে লাগল। দেখছ না গরু, ঘোড়া, মোষ, কুকুর এমন কি হাতি—যে হাতি, সেই হাতি পর্যন্ত ওদের গোলাম হয়ে খেটে মরছে!
ওমা, তাই নাকি! এসব কথা তো কোনো দিন শুনিনি।
শুনবে আবার কি? দেখছ না চোখে? চোখ নেই? তারপর শোন, যারা কিছুতেই বশ মানতে চাইল না, ওরা তাদের মেরে-কেটে শেষ করতে লাগল। ওদের যন্তর মন্তর কত কি। আমরা কি ওদের সঙ্গে পারি? দেখ না, কত কষ্টে জান বাঁচিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের মতো বুনো পশুদের সংখ্যা দিন দিনই কমে আসছে। এভাবে আর ক’দিন?
শেয়ালিনী মেয়ে সন্তান। এ সমস্ত কথা কোনো দিনই শোনে নি। কাজেই কোনো দুর্ভাবনাও তার ছিল না। আজ এক সঙ্গে অনেক ভাবনা তার মাথার উপর চেপে বসল। সে বলল, তাই তো, তবে আমাদের উপায়? আহা আমার বাছাদের কি গতি হবে?
শেয়াল মহা উৎসাহে লাফিয়ে উঠল, ভাবছ কেন শেয়ালিনী, এবার আমাদের দিন ফিরছে। সেই খবরই তো বলতে এলাম। ওদের নিজেদের যন্তরে ওরা নিজেরাই মরতে চলেছে। এবার আমাদের রাজ্য আবার আমাদের হাতে ফিরে আসবে। আসবেই আসবে। আবার বন-জঙ্গলে সারা পৃথিবী ছেয়ে যাবে। তখন কি মজা।
হ্যাঁ গো, একি সত্যি কথা? তুমি আমায় ফাঁকি দিচ্ছ না তো?
ছি ছি, আমি তোমায় ফাঁকি দেব? আর এক কথা শোনো, আমাদের বুড়োরা বলত, আড়াই বছর পরেই হোক বা আড়াই শ বছর পরেই হোক বা আড়াই হাজার বছর পরেই হোক বা আড়াই লাখ বছর পরেই হোক, এই রাজ্য দু-পেয়েদের হাত থেকে আমাদের চার পেয়েদের হাতে ফিরে আসবে। বয়সের গরমে আগে এসব কথা গ্রাহ্যি করি নি। এখন দেখছি সেই কথাই তো ফলতে চলল। বুড়োদের কথার দাম আছে।
হঠাৎ শেয়ালনীর একটা কথা মনে পড়ে গেল, আচ্ছা ওই যে সামনের গেরস্ত বাড়ির ছোট ফুটফুটে খোকাটা, ওকেও কি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকেও মরতে হবে। ওরা কেউ বাঁচবে না। ঝাড়ে-বংশে সব লোপ পাবে।
আহা! এত আনন্দের মধ্যেও শেয়ালনীর বুক থেকে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেল।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments