মামা-ভাগ্নের কাহিনী

বাঘ বলল, হালুম!

তার মানে? তার মানে আমার খিদে পেয়েছে, আমি খাব।

সেই ডাক শুনে সারা বনের পশু-পাখি চমকে উঠল। ওরে বাপরে বাপ, এক একটা ডাক ছাড়ে আর সারাটা বন যেন কাঁপতে থাকে থর থর করে। পশুরা হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু করে দিল—পালা, পালা, পালা!

একটা লম্বা ঘুম ঘুমিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার পর গা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বসেছে বাঘ।

পেটে এখন খিদেয় আগুন জ্বলে উঠেছে। তাই বাঘ বলল,—হালুম! তার মানে আমার খিদে পেয়েছে, আমি খাব।

ঠিক এমনি সময় শেয়ালও বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে। পড় তো পড় একে বারে বাঘের মুখোমুখি পড়ে গেল। অবশ্য বাঘ আর শেয়াল মামা-ভাগ্নে! মামা কি আর ভাগনেকে খাবে? কিন্তু তবুও এই খিদের সময় ওর মুখের সামনে পড়ে যাওয়াটা ভালো হয় নি, শেয়াল মনে মনে ভাবল।

যা হয়ে গেছে, হয়েই গেছে, কি আর করা যাবে! শেয়াল মিষ্টি হাসি হেসে বলল, মামা গো, মামা, নমস্কার। শরীর গতিক ভালো তো?

বাঘ বলল, শরীরও ভালো, গতিকও ভালো, কিন্তু মুসকিল কি জানো, খিদের ঠেলায় মনটা খাই খাই আর প্রাণটা যাই যাই করছে।

শেয়াল শুনে আঁতকে উঠল, ও বাবা, মনে মনে যা ভয় করেছে তাই। শেষপর্যন্ত তাকে দিয়েই খিদে মেটাবে না তো?

বাঘও মনে মনে সেই কথাটাই ভাবছিল। কিন্তু দেশশুদ্ধ সবাই জানে শেয়াল বাঘের ভাগনে। এখন মামা হয়ে সে যদি ভাগনেকে খায় তাহলে দেশে দেশে নিন্দে রটে যাবে। তা ছাড়া শেয়ালের মাংস বড় শক্ত, রস-কস নেই, পেটে গিয়েও সেদ্ধ হতে চায় না। তা ছাড়া বড় বেশি শেয়াল-শেয়াল গন্ধ। কিন্তু তেমন খিদে লাগলে তখন আর শক্ত নরম! খিদের মুখে বার্লিও ভালো লাগে।

বাঘ বলল, কি বলব ভাগনে, খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম,—এ বনে কত রকমের কত জানোয়ার, কিন্তু এখন এক ব্যাটার সঙ্গেও দেখা নেই। কোথায়-যে সব পালিয়েছে! এই তোমার সঙ্গেই প্রথম দেখা হলো।

কথা শুনে শেয়ালের বুক ভয়ে দুরু দুরু করে উঠল। কে জানে, আজ কি আছে কপালে! কিন্তু ভয় পেলেও একেবারে ঘাবড়ে গেল না। মনে মনে নানা রকম ফন্দি ফিকির আঁটতে লাগল।

শেয়াল বলল, মামা তোমারই তো দোষ। পেরথমেই অমন হালুম করে উঠলে কেন? শব্দ শুনেই সবাই পালিয়েছে। এরপর কে আর বসে থাকবে।

বাঘ বুঝতে পারল কথা ঠিকই, অমন করে হালুম করে ওঠাটা তার ঠিক হয়নি।

সে বলল, যা হবার হয়ে গেছে। এখন তুমি তো ওদের অন্ধি-সন্ধি সবই জানো। ওরা কোথায় পালিয়েছে, আমাকে একটু দেখিয়ে দাও দেখি। আর না যদি দেখাও, তোমারই বিপদ। আমি তো আর না খেয়ে থাকতে পারব না। সত্যি করে বলছি, তোমাকে খাবার ইচ্ছে কিন্তু আমার একটুও নেই। তুমি শুধু একটাকে ধরিয়ে দাও। ব্যস, তারপর তোমার ছুটি। আর শোন, তোমাকেও এমনিতেই খাটাব না, তোমাকেও কিছুটা ভাগ দেব।

শেয়াল মহাবিপদে পড়ে গেল। ওদের পালাবার জায়গা কোথায়, সে খবর তার জানা আছে। ইচ্ছে করলেই দু-চারটাকে ধরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু যাদের সঙ্গে সব সময় ওঠা বসা, চলাফেরা, তাদের কি অমন করে বাঘের মুখে তুলে দেওয়া যায়! আর একথা যদি একবার ফাঁস হয়ে যায়, তবে কি আর রক্ষা আছে। বনের সব পশু মিলে তার দফা রফা করবে। আর কেমন করেই বা একথা চাপা থাকবে? শেয়াল উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, গাছে গাছে বানরগুলো কান খাড়া করে ওদের কথাবার্তা শুনছে। দেখতে না দেখতে ওরা সব কথা রটিয়ে দেবে। শেয়াল ভাবতে লাগল বাঘকে এখন কি বলা যায়।

বাঘ বলল, ও, আমার কথাটা তোমার পছন্দ হলো না? পালাবার মতলবে আছ বুঝি? ও সব বুদ্ধি করো না, মরবে। আমার হাতে পড়েছো যখন, ছাড়াছাড়ি নেই। লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার কথা মতো কাজ কর। এতে তোমারও ভালো আমারও ভালো।

শেয়াল বলল, মামা, এ তোমার কেমন কথা? আমি এদিকে তোমার জন্য ভেবে মরছি, আর তুমি আমায় এমন কথাটা বলতে পারলে?

বাঘ বলল, ভাগনে, তুমি দুঃখ করো না। ও কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। তবে খিদের জ্বালায় অনেক সময় উল্টোপাল্টা কথা বেরিয়ে যায়। ও তো আমার দোষ নয়, ক্ষিদের দোষ। এখন বল দেখি, তোমার বুদ্ধিটা কি? তুমি তো বুদ্ধির সাগর, একথা সবাই জানে।

শেয়াল উত্তর দিল, আমি শেয়াল পণ্ডিত, সব ব্যাটারই খবর রাখি। ধরিয়ে দেবো, তা আর বেশী কথা কি? শোনো মামা, ওরা তোমার ভয়ে বড়-ছোট অনেকেই নদীর ধারে লুকিয়েছে। আমাকেও ডেকেছিল। আমি বলে দিয়েছি, যেতে হয় তোরা যা। আমার মামা আমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, নদী তো এখান থেকে কিছুটা দূরে। তুমি অত দূরে যেতে চাইবে?

বাঘ বলল, কি আর করা যাবে। না যেয়ে তো আর ওদের পাওয়া যাবে না। চলো, তবে সেখানেই। আমি আবার নদীর পথ চিনি না। তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।

বাঘ বড় হুঁশিয়ার। শেয়ালকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে চায় যাতে না পালাতে পারে। চলতে চলতে দুজনে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু নদীর তীর একদম খালি। চাঁদের আলোয় নদীতীরের বালিগুলো চিক চিক করছে।

একে পেটে ক্ষুধার জ্বালা, তার উপরে এতটা পথ হাঁটা। এমনিতেই বাঘের মন মেজাজ বিশেষ ভালো ছিল না। এখন এসে দেখে খাঁ খাঁ করছে নদীর তীর, কোথাও কিছু নেই।

বাঘ চোখ লাল করে বলল, বটে, আমার সঙ্গে ফাঁকিবাজি!

শেয়াল বলল, এই তো তোমার দোষ, একটুতেই রেগে যাও। আমি কি তোমার সঙ্গে ফাঁকিবাজি করতে পারি? চেয়ে দেখ ভালো করে নদীর মধ্যে কি?

বাঘ জিজ্ঞাসা করল, কি নদীর মধ্যে?

শেয়াল বলল, দেখতে পাচ্ছ না, তোমাকে আসতে দেখেই সব ব্যাটাই নদীর মধ্যে গিয়ে নেমেছে। মাথা পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়ে শুধু নাকটা তুলে দম নিচ্ছে।

সত্য কথাই তো। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল নদীর জলে কি যেন কিলবিল করছে। বাঘ বড় একটা নদীর ধারে থাকেনি। কুমীর কাকে বলে সেটাও তার আন্দাজ নেই। সে কেমন করে বুঝবে এই নদীতে কুমীরের মেলা বসেছে। যেই না দেখা, আর কি কথা আছে, এক লাফে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কুমীরেরা কেউ এজন্য তৈরী ছিল না। কিন্তু তৈরী হতে সময় লাগল না। দুটো পালোয়ান কুমীর বাঘের পেছনকার ঠ্যাং দুটো কামড়ে ধরল। বাঘ চিরকাল সবাইকে কামড়ে খেয়েছে, তাকে তো কেউ কামড়ায়নি। এবার সে ভালো করেই বুঝতে পারল গায়ের মধ্যে দাঁত ফুটিয়ে দিলে কেমন লাগে। এ আবার কোন্ দেশী জানোয়ার?

বাঘ যন্ত্রণায় চিৎকার করে চলল আর শেয়ালকে ডেকে বলতে লাগল, ভাগনে, ভাগনে, তোমার হাতটা বাড়াও, আমি-যে উঠতে পারছি না।

শেয়াল উত্তর দিল, মামা গো, কাল আছাড় খেয়ে পড়ে দুটো হাতই-যে মচকে গেছে। আমি হাত বাড়াতে পারছি না।

বাঘ জলের মধ্যে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে দিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কুমীরগুলো তাকে টানতে টানতে গভীর জলে টেনে নিয়ে চলল। বাঘ এবার কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও ভাগনে, ভাগনে গো, আমাকে রক্ষা করো। তুমি যা চাও, তাই দেবো।

শেয়াল উত্তর দিল, মামা গো মামা, নমস্কার। আমি যা চাই তা তো পেয়েই গেছি। এবার আমি চললাম। খবরটার জন্য ওরা সব অপেক্ষা করে আছে যে!

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice