নেকড়ে বাঘের বাচ্চা
নেকড়ের বাচ্চাটা জন্মাবার কয়েক দিন পরেই মরে গেল। নেকড়ে তার বাচ্চার শোকে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়ায়। আহা, কি সুন্দর ডাগর ডোগর বাচ্চাটা! কেমন কুঁত কুঁত করে চাইত, আর টলমল করে হাঁটত। কত নেকড়ে তো আছে বনে, কিন্তু কই, কারুর বাচ্চা তো এমন হয় না। এমন বাচ্চাটা মরে গেল, ওর মা কেমন করে সইবে?
নেকড়ে এদিকে যায়, ওদিকে যায়, সারাদিন কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কিছুতেই আর শান্তি পায় না। পাঁচটা না, সাতটা না, একটা মোটে বাচ্চা, তাও মরে গেল! একা একা ও আর থাকতে পারে না।
একদিন চলতে চলতে হঠাৎ সে চমকে উঠল। দেখে, ঝোপের ধারে একটা বানর ছানা বসে বসে খুব মন দিয়ে পেট চুলকোচ্ছে। একদম কচি বাচ্চা। খেলতে খেলতে দল ছেড়ে একটু দূরে চলে এসেছে। ওকে দেখেই নেকড়ের মনে পড়ে গেল তার সেই মরে যাওয়া বাচ্চাটার কথা। আর যেই না মনে পড়া, অমনি কী-যে তার হলো, সে বাচ্চাটাকে কামড়ে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে ছুট মারল।
বাচ্চাটা ভয়ে কিচমিচ করে ওর গলায় যত জোর আছে, তাই নিয়েই চেঁচিয়ে উঠল। ওর চিৎকার শুনে ওর মা আর সব বানরেরা যে যেখানে ছিল, সবাই দল বেঁধে তেড়ে এলো। কিন্তু এলে কি হবে? নেকড়ে ততক্ষণে ওকে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
সেই অন্ধকার গর্তের মধ্যে এসে বাচ্চাটা ভয় পেয়ে ‘মা মা’ বলে কাঁদতে লাগল। নেকড়ে বলল, কাঁদিস নে বাছা। আমি এখন তোর মা। নে এখন শান্ত হয়ে বসে একটু দুধ খা।
বাচ্চা বলল, না না, তুমি কেন আমার মা হবে? আমার মা কত সুন্দর। তুমি কে? তুমি কেনো আমাকে এখানে নিয়ে এলে?
নেকড়ে ওকে অনেক করে বোঝাতে লাগল। কিন্তু বোঝালে কি হবে? তাকে মা বলে ডাকল না, তার দুধও খেল না। ও শুধু এই কথাই বলতে লাগল, না না, তুমি তো আমার মা নও। তোমার দুধ আমি কেন খাব?
পুরো একটা দিন কাঁদতে কাঁদতে গেল। কিন্তু ক’দিন আর এভাবে কাঁদবে? সব জিনিসেরই শেষ আছে। আস্তে আস্তে সে তার আগেকার সব কথাই ভুলে গেল। নেকড়েকেই সে এখন তার মা বলে জানল। এখন আর ওর মনে কোনোই আফশোস নেই। নেকড়েও তাকে নেকড়ের বাচ্চার মতোই বড় করে তুলল। বাচ্চাটাও এখন আর গাছে ওঠে না। গাছে উঠতে যেন ভুলেই গেছে। সে দিনরাত তার নেকড়ে-মা’র পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়।
একদিন সে তার নেকড়ে-মা’র সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় তার বিষম পিপাসা লাগল। ও বলল, মা, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, জল খাব। নেকড়ে-মা বলল, যা, ওই-যে ডোবাটা আছে ওখানে গিয়ে জল খেয়ে আয়। ও বলল, তুমি আমার সঙ্গে চল মা, আমার একা যেতে ভয় করে।
ভয়? ভয় আবার কিসের? বড় হয়েছিস্ না এখন? এই তো কাছেই ডোবাটা। যা, আমি এইখান থেকে চেয়ে আছি। কি আর করে! বাচ্চা আস্তে আস্তে ডোবার ধারে গেল। কিন্তু যেই না জলের ধারে মুখ নামিয়েছে, অমনি লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলো আর বিষম ভয় পেয়ে কিচমিচ করে উঠল। ওর চেঁচানি শুনে ওর নেকড়ে-মা এক ছুটে ডোবার ধারে এসে জিজ্ঞেস করল, কি রে, কি হয়েছে? অমন করছিস কেন?
বাচ্চা কাঁপতে কাঁপতে বলল, দেখ না, ওই জলের মধ্যে একটা কি? নেকড়ে-মা জলের ধারে গিয়ে বলল, কই, কি আবার, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। কি-যে ভীতু হয়েছিস্ তুই। শুধু শুধুই ভয় পাস!
বাচ্চা নেকড়ে-মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, দেখ না তুমি, জলের মধ্যে বানরের মতো একটা কি। আমাকে ভেংচি কাটছে।
নেকড়ে এবার বুঝতে পারল, বাচ্চা তার নিজের ছায়া দেখে ভয় পেয়েছে। বাচ্চা জানে সে নেকড়ের বাচ্চা নেকড়ে। সে-যে বানর, এ কথা সে কেমন করে জানবে! নেকড়ে ওর কাণ্ড দেখে মনে মনে হাসল। শেষে বলল, দূর বোকা, ও তো একটা বানর। ও তোর কি করতে পারবে?
বাচ্চা বলল, বানর কেমন করে হবে? বানর তো গাছে থাকে। নেকড়ে ওকে বুঝিয়ে দিল যে, এক রকম বানর আছে, তারা জলেই থাকে। এ হচ্ছে তাই, এদের নাম জলবানর।
বাচ্চা মা’র মুখে যা শুনল, তাই বিশ্বাস করল। কেনই বা বিশ্বাস করবে না। মা কি আর মিছে কথা বলবে?
এর কিছুদিন বাদে একদিন সে একাই বেরিয়েছিল। মা ছিল না সাথে। একটা বনডুমুরের গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় উপর থেকে একটা বানর তাকে ডেকে বলল, এই বাচ্চা, তুই বানরের বাচ্চা হয়ে নেকড়ের পেছন পেছন ঘুরিস, তোর লজ্জা হয় না? বেঈমান কোথাকার।
বাচ্চা ওর কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সব যা-তা বলছ? কে বানরের বাচ্চা, আমি তো নেকড়ের বাচ্চা নেকড়ে।
বানর হেসে উঠল। সে হাসি আর থামাতে চায় না। শেষে হাসি থামিয়ে বলল, হাসালি তুই। বানরের ঘরে যে এমন বোকাও জন্মায়, তা তো জানতাম না। নেকড়ের পেছনে পেছনে ঘুরলে কি হবে, তুই আমাদের মতোই বানর।
বাচ্চা কিছুতেই এ কথা মানল না, বলল, না, আমি নেকড়ে। আমি কেন বানর হব?
বানর ডেকে বলল, উপরে আয়, তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি, তোর দেহের সবটুকুই বানর, একটুও নেকড়ে নয়।
বাচ্চা বলল, আমি নেকড়ে, আমি তো আর গাছে উঠতে পারি না। তুমি নীচে নেমে এসে কি বলবে বলো।
বানর তার এই কথা শুনে নীচে নেমে এসে তাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল যে, সে সারা দেহেই বানর, একেবারে খাঁটি বানর। নেকড়ে তাকে ভুল বুঝিয়েছে।
বাচ্চা প্রশ্ন করল, নেকড়ের পেটে কি কখনও বানর হয়?
বানর বলল, না, তা হয় না। কিন্তু তুই তো নেকড়ের বাচ্চা মোটেই নস। তুই ষোল আনা বানরের বাচ্চা।
অমন অদ্ভুত কথা বাচ্চা আর কখনও শোনেনি। সে বলল, তোমার মুখের কথায় আমি বিশ্বাস করি না। প্রমাণ করে দেখাও যে, আমি বানর।
বানর একটু ভাবল। শেষে বলল, আচ্ছা চল, ওই ডোবার ধারে।
দুজনেই ডোবার ধারে গেল। বানর বলল, এবার জলের মধ্যে চেয়ে দেখ, ওটা কি?
বাচ্চা বলল, ওটা তো জলবানর। বানর তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল, জলবানর? সেটা আবার কি? ওরে হাঁদা, এইটেই তো তোর চেহারা, এ তো তোর ছায়া। কেমন, বাঁদর নস্ তুই?
বাচ্চা কিছুতেই ওর কথা মানল না। সে বলল, আমি তো এখানেই আছি আমি ওখানে যাব কি করে? আর আমি বুঝি ওর মতো বিচ্ছিরি দেখতে?
বানর বলল, কি মুসকিলেই পড়লাম তোকে নিয়ে। আচ্ছা, তুই হাঁ কর দেখি।
বাচ্চা হাঁ করল। বানর আঙ্গুল দিয়ে দেখাল, ওই দেখ, ওটাও হাঁ করছে। সত্যিই তো?
তুই তোর ডান হাতটা তোল। বাচ্চাটা তার ডান হাত তুলল।
দেখেছিস্, ওটাও ওর ডান হাত তুলছে। সত্যিই তো?
বানর বলল, এখন বুঝলি তো, ওটা তুই নিজেই। ওর নাম ছায়া।
বাচ্চা বলল, না, না, আমি কেন হব? ও জলবানর। ও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।
বটে, ভয় দেখাচ্ছে? দেখ তো ওর পাশে দাঁড়িয়ে কে? আমি না?
সত্যিই তো। এবার বাচ্চা আর কোনো কথাই বলতে পারল না। সে ছুটতে ছুটতে এক দমে মায়ের কাছে এসে হাজির।
এসেই সে মায়ের কাছে সব কথা খুলে বলল। প্রথমে কথাটা চাপা দিতে চেয়েছিল,
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments