ঢাকা শহরে চান্দিনা প্রজাস্বত্ব আন্দোলনের নেতা মহম্মদ সফীউল্লাহ

সুত্রাপুরের ১৯নং ওয়ালটার রোডের বাড়িটাকে আজ ক’জনই-বা চেনে! কিন্তু আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে এই বাড়িটা পুরানো ঢাকা শহরের অধিবাসীদের অনেকের কাছে বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় এই ঢাকা শহরে জমিদারদের সুপরিকল্পিত উচ্ছেদনীতির বিরুদ্ধে চান্দিনা স্বত্বের প্রজাদের এক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এই বাড়িটি আর তার স্রষ্টা ছিলেন এই বাড়ির মালিক মহম্মদ সফীউল্লাহ।

বিদ্যার দিক দিয়ে ম্যাট্রিক ফেল হলেও সফীউল্লাহ তাঁর নিজের পাড়ায় সুশিক্ষিত হিসাবেই গণ্য ছিলেন। এই অঞ্চলের স্থানীয় মুসলমান সমাজে ম্যাট্রিক পাস করা ছেলে তখন সুলভ ছিল না। কোনোকিছু নিয়ে লেখালেখি করার প্রয়োজন হলে পাড়ার লোক তাঁর কাছেই ছুটে আসত। ফলে তিনি মুখে মুখে ‘মাষ্টার’ নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর বাবা ছিলেন ভাওয়াল রাজ ষ্টেটের খলিফা। তাঁর মাসিক বেতন ছিল মাত্র সতেরো টাকা। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করে লেখাপড়ায় ইতি দিয়ে সফীউল্লাহ পুলিস লাইনে সাব-ইন্সপেক্টরের চাকরিতে ঢুকলেন। কিন্তু পুলিস লাইনে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। বাদ সাধলেন তাঁর মা। চাকরি প্রাপ্তির সুসংবাদ বহন করে নিয়ে যেতেই তাঁর মা তাঁকে আখেরীবাত শুনিয়ে দিলেন যে, পুলিসের চাকরিতে ইস্তাফা না দিলে তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কি করেন বেচারা। মায়ের কথার উপর কথা চলে না, তাই সাত দিনের মধ্যেই তিনি চাকরিতে ইস্তাফা দিলেন। তাঁর মা ছিলেন ফরাসগঞ্জের সুপরিচিত তালুকদার লাল খাঁনের মেয়ে। শেষ জীবনে লাল খান-এর তালুকদারী ঋণের দায়ে তলিয়ে গিয়েছিল। গোটা কয়েক মোহর আর এই তেজটুকু ছাড়া উত্তরাধিকার হিসাবে মেয়েকে আর কিছুই তিনি দিয়ে যেতে পারেননি।

পুলিস লাইনের এই চাকরি নিজের হাতে খতম করে দিয়ে সফীউল্লাহ অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ১৯১৫ সালে অস্থায়ীভাবে উয়ারী পোষ্ট অফিসে কেরানীর কাজে ঢুকলেন। বছর দুইকাল এখানে কাজ করার পর ম্যাট্রিক ফেল বলে এই চাকরিটুকুও তাঁকে হারাতে হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত পাট ব্যবসায়ী ডেভিড কোম্পানীর অধীনে চাকরি নিলেন। এখানে বছর দশেক কাজ করার পর তাঁর হাতে কিছু টাকা জমল। এবার তিনি ৫নং ইসলামপুরে ‘ষ্টুডেন্টস সু ষ্টোর’ নামে একটি জুতার দোকান খুললেন। এবার সফীউল্লার জীবনে এক নতুন অধ্যায় নেমে এলো।

বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরু থেকে তদানীন্তন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখা দেয়। এই ব্যাপক আন্দোলনের ফলে কৃষক-প্রজাদের এই সমস্ত জীবন-মরণ সমস্যার দিকে দেশবাসী ও তদানীন্তন সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এরই ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৩৮ সালের সংশোধিত প্রজাস্বত্ব আইন রচিত হয়! কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই গ্রামাঞ্চলের কৃষক তথা প্রজাসাধারণের সমস্যাগুলির উপরই বেশী জোর পড়ে। কিন্তু শহরের চান্দিনা স্বত্ত্ববিশিষ্ট প্রজাদের উপর জমিদারদের সেই জুলুম-জবরদস্তি ও বলপূর্বক জমি থেকে উচ্ছেদের হামলা চলতেছিল। সে সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞ ছিলেন এবং যাঁরাও বা ওয়াকিবহাল ছিলেন তাঁরাও এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করতেন না।

সফীউল্লাহ নিজে এবং তাঁর পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই চান্দিনা স্বত্বসম্পন্ন প্রজা ছিলেন। জমিদারদের জুলুম-জবরদস্তির জ্বালাটা তাদের মর্মে মর্মে অনুভব করতে হতো। এই শহরের চান্দিনা স্বত্বসম্পন্ন প্রজাদের জমিদারদের জুলুম ও স্বেচ্ছাচারের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সফীউল্লাহ তাঁর জনকয়েক সহকর্মীকে নিয়ে আন্দোলনে নামলেন। তিনি সারা শহরে ঢোল দিয়ে চান্দিনা প্রজাদের এক সভা আহ্বান করলেন। ওয়ালটার রোডের সঙ্গেই তখন খোলা জায়গা ছিল, সেইখানেই ঢাকার চান্দিনা প্রজাদের এই সভা হয়। এই সভায় ‘চান্দিনা প্রজা সমিতি’ গঠিত হয়। সফীউল্লাহ এই সমিতির সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। দুই হাজারের উপর চান্দিনা প্রজা ১ টাকা করে চাঁদা দিয়ে এই সমিতির সভ্য হন। তাদের মধ্যে প্রায় তিন শত জন হিন্দু, বাদ-বাকী সবই মুসলমান। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে পূর্বে গেণ্ডারিয়া, পশ্চিমে বাংলা বাজার, উত্তরে মৈশুণ্ডী-নারিন্দা এবং দক্ষিণে ফরাশগঞ্জ-এই এলাকার চান্দিনা প্রজারা এই সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেক্রেটারীর বাড়ি ১৯নং ওয়ালটার রোডে এই সমিতির অফিসের কাজ চলত। সময় আর সুযোগ থাকতে থাকতে ছলে-বলে-কৌশলে প্রজাদের উচ্ছেদ করে দিয়ে জমিগুলিকে খাস করে নেবার জন্য হিন্দু-মুসলমান জমিদাররা উঠে-পড়ে লেগেছিল। সমিতি হাজার হাজার চান্দিনা প্রজার পক্ষ হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করবার দায়িত্ব নিয়েছিল। এই দায়িত্ব সহজ দায়িত্ব নয়। মামলা পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ তরুণ উকিলকে ‘হোল-টাইমার’ অর্থাৎ সারাক্ষণের কর্মী হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর নাম মোহাম্মদ হোসেন এম. এ. বি-এল। তাঁর বাসা ছিল আরমানীটোলায়। তা ছাড়া একজন টাইপিষ্টকে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হয়। তাঁর নাম রহমান টাইপিষ্ট।

চান্দিনা প্রজাদের দুরবস্থা সম্পর্কে এখনকার দিনের লোকের ধারণা নাই বললেই চলে। এই সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে ২০/১/৪০ তারিখে প্রকাশিত একটি পুস্তিকার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে দেওয়া হলো:

“বাঙ্গলায় কৃষক-প্রজাদের দুরবস্থা ও অভাব-অভিযোগ দূরীকরণার্থ গভর্নমেন্টের প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পুনঃ পুনঃ সংশোধিত হইয়াছে। কিন্তু বঙ্গদেশের অগণিত হাট, বন্দর, বর্ধিষ্ণু গ্রাম, শহর এবং মিউনিসিপ্যালিটির এলাকায় যে সহস্র সহস্র হিন্দু-মুসলমান প্রজা প্রতি-নিয়ত জমিদারদের অত্যাচার ও উৎপীড়নে জর্জরিত ও ভিটেমাটি ছাড়া হইতেছে, বহু আবেদন ও নিবেদন সত্ত্বেও তাহাদের দুর্দশা মোচনকল্পে গভর্নমেন্ট এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করেন নাই।

এই সকল হতভাগ্য প্রজা অনেকে আবহমানকাল হইতে কেহবা পুরুষানুক্রমে গৃহাদি নির্মাণ করতঃ স্ত্রী-পুত্রাদিসহ বসবাস করিয়া ও তাহাদের বসত-বাটিকে বা কারবার স্থলে চাষী প্রজাদের ন্যায় অনুচ্ছেদযোগ্য স্থায়ী স্বত্ব লাভ করিতে পারে নাই। দেশকাল ভেদে ইহারা চান্দিনা বা ভিটি ভূমির প্রজা নামে অভিহিত হলেও ইহাদের দখলীয় ভূমিতে ইহাদের Right and status এত অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট যে, ইহাদের অবস্থা মাসিক ভাড়াটিয়ার চেয়েও খারাপ। সর্বদা অনিশ্চিত অবস্থায় বাস করার দরুন এবং প্রতিনিয়িত উৎখাতের আশঙ্কা থাকার কারণে ইহাদের জীবনে সুখ-শান্তি বা উন্নতি বলিয়া কোনো জিনিস নাই। জমিদারগণ উৎখাতের হুমকি দেখাইয়া নিজেদের মর্জিমাফিক যখন তখন ইহাদের খাজনা বৃদ্ধি করিয়া থাকেন। কখনও বা অদ্ভুত শর্তবিশিষ্ট মনগড়া কবুলিয়ত আদায় করেন। অথবা হস্তান্তর আইনের ১০৬ ধারা মতে মাত্র ১৫ দিন বা ৬ মাসের নোটিশ দিয়া অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তাহাদের বহুকালের পৈতৃক বাস্তুভিটা হইতে গৃহাদি ভাঙ্গিয়া দিয়া উৎখাত করিয়া থাকেন। এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যে, প্রজা পুরুষানুক্রমে ৭০/৮০ বৎসর যাবৎ বসবাস করিয়া এবং পুনঃ পুনঃ সেলামী এবং সাবেক খাজনার ৩০/৪০ গুণ খাজনা প্রদান সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তাহার দখলীয় ভূমিতে স্থায়ী বা কায়েমী স্বত্ব অর্জন করিতে পারে নাই। কোনো কোনো জমিদার অনুচ্ছেদযোগ্য মিরাশী পত্তনের প্রতিশ্রুতিতে প্রজা হইতে অত্যাধিক সেলামী গ্রহণ করিয়াও প্রজার দারিদ্র্য ও অশিক্ষার সুযোগে নিজ বরাবরে ইচ্ছাধীন উচ্ছেদযোগ্য প্রজাস্বত্বের কবুলিয়ত করিয়া রাখিয়াছেন। জমিদার পক্ষ কোনো দিন উৎখাত করিবে না বিশ্বাসে অনেক প্রজা তাহাদের দখলীয় ভূমি নিজ ব্যয়ে ভরাট ও পাকাপোক্ত করিয়াছে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১৫ দিনের নোটিশে গৃহাদি স্থানান্তর করতঃ পৈতৃক ভিটা অশ্রুসিক্ত করিয়া স্ত্রী-পুত্রসহ রাস্তায় বা বনে জঙ্গলে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইতেছে।”

চান্দিনা প্রজাদের স্বার্থের অনুকূলে তাদের প্রজাস্বত্বের সংশোধন করে আইন গঠিত হবার সম্ভাবনা আছে, এই আশঙ্কা করে ঢাকা শহরের জমিদাররা ব্যাপকভাবে প্রজাদের জমি থেকে উৎখাত করে সেই জমি খাস করে নিচ্ছিলেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে তদানীন্তন বাংলা সরকারের রাজস্ব বিভাগের মন্ত্রী স্যার বিজয় প্রসাদ সিংহ রায় ঢাকায় আসেন। সে সময় তাঁর কাছে চান্দিনা প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে ১৫ই জুলাই তারিখে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই স্মারকলিপিতে ঢাকা জজ কোর্টের উকিল জনাব

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice