ঢাকা শহরের নাট্য আন্দোলন
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুকাল বাদেই ঢাকা শহর তথা পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ধারায় একটা জোয়ার এসে গিয়েছিল। অনেক দিনের খরা ও অজন্মার পর কি শহর, কি গ্রামাঞ্চল সর্বত্র আবৃত্তি, নাচ, গান, বিচিত্র অনুষ্ঠানের ঢল নেমে এলো। তার সাথে সাথেই এলো নাট্যাভিনয়। যা এতোদিন এখানকার মুসলমান সমাজের কাছে যেন নিষিদ্ধ ক্ষেত্র বলেই গণ্য ছিল। সেই জোয়ারের বেগ আজও স্তিমিত হয়নি, কিন্তু তার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস আজ প্রতিকূল পরিবেশের গায়ে মাথা ঠুকে ঠুকে মরছে। উপযুক্ত নাটক নাই, হল নাই, ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা নাই, অভিজ্ঞতা নাই, দৃঢ়মূল সংগঠনও নাই। নাই বলতে কিছুই নাই। নিয়মিতভাবে চর্চা করবার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকলে নাট্যাভিনয়ের কালোপযোগী উন্নতি করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তাই প্রথম থেকেই ঢাকা শহরে একটা পাবলিক থিয়েটার গড়ে তোলার দাবী উত্থাপিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে পুত্তলিকার মতো চোখ থাকতেও দেখেন না, কান থাকতেও শোনেন না। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য এ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেন নি। অদূর ভবিষ্যতে যে আসবেন তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থাই যদি চলতে থাকে, তাহলে নাট্যাভিনয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বললেই চলে।
আমাদের দেশের মানুষ আজ সাংস্কৃতিক খাদ্যের জন্য বুভুক্ষু হয়ে উঠেছে। তাদের চাহিদা মিটাইতেই হবে। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার, নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে সুরুচি ও প্রগতি যদি আসন দখল করে নিতে না পারে, তাহলে কুরুচি আর প্রতিক্রিয়া সেই সুযোগে জায়গা নিয়ে নেবে। আসন খালি পড়ে থাকবে না।
কিন্তু আমি এখানে নাট্যাভিনয়ের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি না। আমি এ বিষয়ে ঢাকা শহরের ঐতিহ্যের উপর একটু আলোকপাত করতে চাই। পথচারী কখনও বর্তমানে, কখনও অতীতে যখন যেমন খুশী স্বচ্ছন্দমনে বিচরণ করে বেড়ায়। তার চলাচলে কোনো বাধা নাই। নাট্যাভিনয়ের দিক দিয়ে কি ছিল আর কি ছিল না, এখনকার খুব কম লোকেরই সেসব কথা জানা আছে। এ নিয়ে যে বিশেষ আলোচনা হয়েছে, তাও মনে হয় না। তা ছাড়া তার অনেক কথাই কালস্রোতে বিস্মৃতির গর্ভে মিলিয়ে গিয়েছে।
আজ আমাদের এখানে একটিও থিয়েটার হাউস নাই। কিন্তু বিশ শতকের প্রথম ভাগে ঢাকা শহরে দু’দুটি পেশাদার থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হয়। এই দুটি থিয়েটারের জন্ম-ইতিহাস বিচিত্র। সে সময় কলকাতা ছিল তদানীন্তন বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনের উৎস। যখন এখানে স্থানীয়ভাবে নাট্যাভিনয়ের নাম-গন্ধও ছিল না, তখন থেকেই কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটার তাদের দলবল নিয়ে এখানে এসে অভিনয় করত। এদেরই কোনো দল এখানে এসে বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় করেছিল। পোগোজ স্কুলের প্রাঙ্গণে এই নাটক অভিনীত হয়। এ ছাড়াও কলকাতার দলগুলি এখানে আরও অনেক নাটকের অভিনয় করে। কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারও তাদের দলবল নিয়ে এখানে অভিনয় করে গেছে। সেই দলে হাস্যরসিক অমৃতলাল বোস, অমর দত্ত, কুসুম কুমারী, নেপা বোস প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীরা ছিলেন। ক্লাসিক থিয়েটারের কথা ঢাকা শহরের লোকেরা অনেকদিন পর্যন্ত ভুলতে পারে নি। হরিশচন্দ্র নাটকে নাম ভূমিকায় অবতীর্ণ অমর দত্ত যখন ঘোড়ায় চেপে ষ্টেজের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন, তখন সারা ঘর জুড়ে সেকি হাততালির ঠ্যালা! এ কথা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া এল ষ্টার। তারা গিরীশ ঘোষের লেখা চৈতন্যলীলা ও বুদ্ধচরিত অভিনয় করে যায়। জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে এই নাটক দুটি অভিনীত হয়। এইভাবে কলকাতার থিয়েটারের দলগুলি একের পর এক এখানে এসে অভিনয় করে যাচ্ছিল।
কলকাতার দলগুলির এই সমস্ত নাট্যাভিনয়ের ফলে শহরের লোকের মন থিয়েটারের দিকে ঝুঁকে পড়ল। যাত্রা, কবি-গান ইত্যাদির তুলনায় আধুনিক যুগের নাটক তাদের কাছে অনেক বেশী চমকপ্রদ, মনোহারী ও বাস্তব বলে মনে হলো। নাটকের এই চমৎকারিত্বে মুগ্ধ ও উৎসাহিত হয়ে জুবিলী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৭ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্য শাসনকালের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করেন।
ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার ঢাকার প্রথম পেশাদার নাট্যভবন। ইসলামপুরে আশেক লেনের এক টিনের বাড়িতে এই নাট্যভবনের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীকালে এই থিয়েটার ঢাকা শহরে সুপরিচিত মির্জা আবদুল কাদের সরদারের হাতে চলে যায়। কিছুকাল বাদে কাদের সরদার এই থিয়েটারের নাম বদলে দিয়ে “লায়ন থিয়েটার” নামকরণ করেন। পরে যখন নাটক অভিনয় বন্ধ হয়ে গিয়ে এটি সিনেমা হাউসে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন এর নাম হয় “লায়ন সিনেমা”। সেই লায়ন সিনেমা আজও চলছে।
ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হবার পর বছর কয়েক বাদে ক্রাউন থিয়েটারের সৃষ্টি হয়। নবাববাড়ির কাছে ইতিপূর্বে যেই বরফ কলটি ছিল তারই পাশে ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটারের মতোই একটি টিনের বাড়িতে ঢাকার দ্বিতীয় পেশাদার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। তাঁতীবাজারের রাখাল বসাক এই ক্রাউন থিয়েটারের জন্মদাতা। ইসলামপুর মিছিলের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে রাখাল বসাক ঢাকার নাগরিকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।
ক্রাউন থিয়েটার প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, এখানে অভিনীত চন্দ্রশেখর নাটকে পরবর্তীকালের শিশির ভাদুড়ীর “সীতা” নাটকে বাল্মিকীর ভূমিকায় প্রখ্যাত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য চন্দ্রশেখরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ঢাকা জেলার কামারখাড়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি এখানকার কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তাঁর পেশা ছিল অধ্যাপনা। ক্রাউনে তিনি যখন চন্দ্রশেখরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তখন পর্যন্ত তিনি কোনো পেশাদার থিয়েটারের দলে যোগ দেননি। পরে শুধু নাট্যজগতে নয়, সিনেমাজগতেও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য একজন খ্যাতনামা শিল্পী হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। কলকাতার থিয়েটার-সিনেমার কাগজগুলিতে তাঁকে পদ্মাপারের প্রথম সার্থক অভিনেতা বলে বর্ণণা করা হতো।
ঢাকার এই পেশাদার থিয়েটার দুটিতে ৪ শ্রেণীর টিকেটের ব্যবস্থা ছিল: প্রথম শ্রেণী (গদি)-২ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণী (চেয়ার)-১ টাকা, তৃতীয় শ্রেণী (টুল)-১০ আনা, চতুর্থ শ্রেণী (গ্যালারী)-১ আনা।
কলকাতার অনুকরণে পেশাদার থিয়েটার চালালেও এখানকার ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই অসন্তোষজনক, দর্শকদের সুখ-সুবিধার দিকে খুব কমই নজর দেওয়া হতো। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি। একবার শিশির ভাদুড়ী তাঁর দল নিয়ে তখনকার ‘লায়ন থিয়েটারে’ অভিনয় করতে এসেছেন। টিকেটের সর্বনিম্ন অর্থাৎ গ্যালারীর রেট ২ টাকা। সে সময় লায়ন থিয়েটারের কাঠের গ্যালারী ভেংগে যাওয়ার ফলে ইট দিয়ে নামকে-ওয়াস্তে কোনমতে একটা গ্যালারী খাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। গ্যালারীর দর্শকদের সেই তথাকথিত গ্যালারীতে বসেই অভিনয় দেখতে হবে। দর্শকদের পক্ষ থেকে অবশ্য এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। কিন্তু গ্যালারীর এই শ্রী দেখে শিশির বাবু রেগে আগুন হয়ে উঠলেন: কি, ২ টাকা দর্শনী দিয়ে এখানে বসে অভিনয় দেখতে হবে! এর নাম গ্যালারী! খেলা পেয়েছ তোমরা! শিশির বাবুকে এভাবে রেগে উঠতে দেখে থিয়েটার কর্তৃপক্ষ শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু একটু বাদেই যে অভিনয় শুরু হয়ে যাবে। এ অবস্থায় তারা আর কিইবা করতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে কর্তৃপক্ষ লাল শালুর কাপড় দিয়ে সেই ইটের গ্যালারীকে ঢেকে তার শ্রী একটু ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবেই সেদিনকার মতো সমস্যাটার সমাধান হল।
ঢাকা শহরে পেশাদার থিয়েটার পরিচালনা সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে, প্রথম দিকে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সেটকে সেট পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানী করা হতো। আমাদের বাগাল দেশের উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি খোদ বাঙালদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। শুনতে একটু বিচিত্র মনে হলেও কথাটা সত্য। পরে অবশ্য দু’জন একজন স্থানীয় লোককেও নেওয়া হতে লাগল। তাদের মধ্যে কয়েকজন অভিনেতা হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
এই পেশাদার থিয়েটার দুটিতে যারা অভিনয় করতেন তাদের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েক নাম আপনাদের কাছে উপহার দিতে পারলাম।
সবচেয়ে প্রথম নাম করতে হয় অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি। বাংলার নাট্যাকাশে অর্ধেন্দু মুস্তাফি
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments