ওরা বারো জন

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।

ভারতীয় বেতার মারফৎ একটি সংবাদ প্রচারিত হলো-ঢাকা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কোনো এক জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। খবরটা চাঞ্চল্যকর, বিশেষ করে ঢাকা জেলার লোকদের কাছে। দিনের পর দিন বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা জেলায় তাদের প্রতিরোধের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য ২৫-এ মার্চ তারিখে সামরিক হামলার প্রথম রাত্রিতে রাজারবাগের পুলিশ ভাইয়েরা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এই কাহিনী অবিস্মরণীয়। তার দুই দিন বাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের সংগ্রামী ভাইয়েরা শুধুমাত্র গোটা কয়েক রাইফেলের উপর নির্ভর করে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত সৈন্যদলকে দুই দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল। শহরে ঢুকতে দেয় নি। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তারা সবাই তরুণ ও কিশোর; অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে একেবারেই কাঁচা। আমাদের এই সংগ্রামী ভাইদের জন্য ঢাকা জেলার মানুষ সঙ্গতভাবে গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু তারপর?

তারপর থেকে সারা ঢাকা জেলায় মুক্তিসংগ্রামীদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঢাকা জেলার মানুষ দুঃখ করে বলে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাই শুধু পেছনে পড়ে আছি।

কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই জায়গাটা কোথায় তাই নিয়ে বিতর্ক ও বাদানুবাদ চলে। দূরত্ব সম্পর্কে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। কেউ বলে সাভার, কেউ বলে নরসিংদী, আবার কেউ বলে জয়দেবপুর। আবার এমন লোকও আছে যারা এই ভারতীয় প্রচারণাকে একদম গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একে সত্যি বলে বিশ্বাস করে। শুধু যে বিশ্বাস করে তাই নয়, নিজেদের কল্পনার সাহায্যে তাদের আরো দ্বিগুণ করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। ইতিপূর্বে নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী বোমারু বিমান বোমা ফেলেছে। এটা ভারতীয় বেতারের প্রচার নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বোমাবিধ্বস্ত নরসিংদীর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এসেছে।

বাইরের লোকে এটুকুই শুধু জানল, কিন্তু ঠিক কোনো জায়গায় যুদ্ধ বেধেছিল এবং যুদ্ধের ফলাফল কি সেই সম্পর্কে কারো মনে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাছাড়া নিত্য নতুন এমন সব চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে যে শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই সংঘর্ষ সম্পর্কে কে আর মাথা ঘামায়!

যারা বাইরের লোক তাদের কাছে ঘটনাটা ছোটো হতে পারে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ঘটনাটা দারুণ উত্তেজনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। আমার এক বন্ধু তার নিজস্ব কাজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেইজন্যই এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পারছি। আজ সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই ধরনের যে-সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে, তার কতটুকু খবরই বা আমরা রাখি!

পাকিস্তানের বোমারু বিমান ৪ঠা এপ্রিল ও ৫ই এপ্রিল পর পর দুই দিন নরসিংদীর উপর বোমা ফেলেছিল। তারপর দিন সাতেক কেটে গেল, ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য বা মুক্তিবাহিনী কেউ নরসিংদীতে প্রবেশ করে নি। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা নরসিংদী দখল করবার জন্য ছুটে আসছে। গুজব না, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের দেখে এসেছে।

তাঁতের কাপড়ের হাট হিসেবে বিখ্যাত বাবুরহাট থেকে জিনারদী পর্যন্ত একটি রাস্তা চলে এসেছে। মাইল সাতেকের পথ, জিনারদী থেকে নরসিংদী তিন মাইল। সৈন্যরা এই পথ ধরে এগিয়ে আসছিল। তাদের দলে কয়েক শ’ সৈন্য। সৈন্যবাহিনীর ট্রাকগুলি একের পর এক মিছিল করে আসছিল। তাদের সঙ্গে মর্টার, রকেট, মেসিনগান-কোনো কিছুরই অভাব নেই। মুক্তিবাহিনীর ‘দুষ্কৃতকারী’ লোকগুলিকে তারা নিঃশেষে খতম করবে, চূর্ণ করে ধূলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।

বাবুরহাট থেকে জিনারদী, মাঝখানে পাঁচদোনা গ্রাম। এই পাঁচদোনা গ্রামের কাছে সংঘর্ষটা ঘটেছিল, সেদিন ১৩ই এপ্রিল। প্রথমে গোটা পাঁচেক সৈন্যবাহী ট্রাক। এই ট্রাকের কনভয় থেকে সৈন্যরা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। পথ জনশূন্য। তবে মাঝে মাঝে দু’টি একটি অতি সাহসী কৌতূহলী লোক ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ এক সময় শান্ত পল্লী-প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম-পর পর তিনবার কামানের গর্জন শোনা গেল। অতি পরিচিত মর্টারের আওয়াজ। শুধু আওয়াজই নয়, একটা গোলার টুকরা ছিটকে এসে একটা ট্রাকের উপর পড়ল। ট্রাকের উপর সৈন্যদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে আক্রান্ত হতে হবে এটা ওরা ভাবতে পারে নি। ওরা কি তবে শত্রুপক্ষের কব্জির মধ্যে এসে পড়েছে? এই অচেনা অজানা নির্বান্ধব দেশে তারা কি করে আত্মরক্ষা করবে? প্রতিপক্ষ সহজ নয়, ওরা মর্টার নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। প্রতিপক্ষ সহজ নয়, ওরা মর্টার নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। ওদের সঙ্গে কতো লোক আছে কে বলবে? এরা সংখ্যায় বড় কম হবে না, তা না হলে এরা এভাবে আক্রমণ করতে সাহস করত না। যারা আক্রমণ করেছে, তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে এমন সুকৌশলে আত্মগোপন করে আছে যে, রাস্তা থেকে তাদের কোনোমতেই দেখা যায় না। ট্রাক নিয়ে সেই দিকে এগোবার উপায় নেই, যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু সেটা কোনোমতেই নিরাপদ নয়। ওদের সঙ্গে শুধু মর্টার নয়, মেসিনগানও আছে। এক পশলা বৃষ্টির মতো কয়েক ঝাঁক মেসিনগানের গুলি ট্রাকের উপর এসে পড়ছে। প্রথম পর্যায়েই সৈন্যদের মধ্যে কয়েকজন মারাত্মক ভাবে জখম হয়ে পড়েছে। সৈন্যরা আর দেরী না করে অনুমানের উপর নির্ভর করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে লাগল। তাদের মেসিনগানও অবিরাম কাজ করে চলেছে।

এইভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের গোলাগুলির বর্ষণ চলল, একে রীতিমত যুদ্ধ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। এই কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে পাক-সৈন্যদের নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মর্টার আর মেসিনগানের গোলাগুলিতে তাদের তিন ট্রাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। এদের সংখ্যা প্রায় এক শ; অপরপক্ষে অদৃশ্য গেরিলা বাহিনীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বুঝে উঠা সম্ভব ছিল না। তবে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, গেরিলা বাহিনীর লোকেরা সংখ্যায় বড় কম নয়। অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা যথেষ্ট শক্তিশালী। এর পর আরও কিছুদূর এগোতে গেলে ওদের ফাঁদের মধ্যে সবশুদ্ধ আটকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় বাবুরহাটের দিকে ফিরে যাওয়াটাই ওরা সঙ্গত বলে মনে করল।

অদৃশ্য মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি বর্ষণ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত এটা ওদের চাল। ওরা প্রলোভন দেখিয়ে আরও দূরে সম্পূর্ণ ওদের আয়ত্তের মধ্যে টেনে নিতে চাইছে। পাক-সৈন্যরা আপাতত বাবুরহাটে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। প্রথম তিনটা ট্রাক একেবারে অচল হয়ে গেছে। নিহত ও জখমী সৈন্যদের দেহ অন্যান্য ট্রাকে বোঝাই করা হলো। এবার ওদের এই শোকের মিছিল ফিরে চলল বাবুরহাটের দিকে। অচল ট্রাক তিনটি এই যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাস্তার উপর পড়ে রইল। বেশ কিছুদিন সেগুলি ঐভাবে পড়ে ছিল।

বেলা বেশী নেই, এই অবস্থায় আর বেশী দূর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ওরা স্থির করল, কাল বাবুরহাট থেকে আবার নতুন করে অভিযান শুরু করতে হবে। প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবস্থা সুবিধাজনক বলে মনে হলে ঢাকা থেকে আরও বেশী সৈন্য আমাদের প্রয়োজন হতে পারে।

এবার মুক্তিবাহিনীর কথায় আসা যাক। যাদের তীব্র আক্রমণে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদল নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তারা সংখ্যায় ছিল মাত্র বারো জন। তাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল শুধুমাত্র একটি মর্টার আর একটি মেসিনগান। এদের মধ্যে কেউ মারা যায় নি, শুধু দু’জন জখম হয়েছিল।

ওদের ঘাঁটি এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে। কোথায় সেই ঘাঁটি এই গোপন কথাটা একমাত্র তারাই জানে। ওরা সেই ঘাঁটি থেকে জোয়ান ছেলেদের নিয়ে বসল। আর তাদের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice