বগুড়ার ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই

বাংলাদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামে বগুড়ার ছাত্রসমাজ সারা প্রদেশের ছাত্রদের মুখ উজ্জ্বল করে তুলেছে। বগুড়ার ছাত্ররা এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের ছাত্র-পতাকাকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যাঁরা এই মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস রচনা করবেন, তাঁদের এই সত্যটিকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। এখানকার প্রতিরোধ সংগ্রামে কোনো বিশেষ নেতা বা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল জনসাধারণকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে নি, প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। শুধু কলেজের ছাত্ররাই নয়, দলে দলে স্কুলের ছাত্ররাও শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পথে নেমে এসেছে। যুদ্ধবিদ্যায় অশিক্ষিত এই কাঁচা বয়সের ছেলেরা একমাত্র দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ পাক-সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে অকুতোভয়ে প্রাণ নিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। এই ছাত্ররা আমাদের জাতীয় গৌরব। বগুড়ার ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই।

দেশকে মুক্ত করতে হলে শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে, ছাত্ররা এই সত্যটিকে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। তাই মার্চের প্রথম থেকে তারা পাড়ায় পাড়ায় প্যারেড আর রাইফেল চালনার ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছিল। ছোটো ছোটো ছেলেরাও এই ট্রেনিং-এ অংশ নিত। এই ট্রেনিং-এর মধ্য দিয়ে শুধু হাত নয়, হাতের চেয়েও বড় কথা, তাদের মনটাও সংগ্রামের জন্য তৈরী হয়ে উঠছিল। এটা শুধু কথার কথা নয়, তারা কার্যক্ষেত্রে এই কথাটিকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছে।

সারাটা মাস ধরে মিছিলের পর মিছিল চলেছিল। ছাত্রদের মিছিল, শ্রমিকদের মিছিল, চাকুরেদের মিছিল, সাধারণ মানুষের মিছিল—মিছিলের আর শেষ নেই। বগুড়ার আকাশ বাতাস মিছিলের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্য দিয়ে এল ২৫-এ মার্চ, সেই অবিস্মরণীয় ২৫-এ মার্চ। অবশ্য বগুড়া শহরে এই দিনটিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে নি।

২৫-এ মার্চ সন্ধ্যেবেলায় ছাত্রদের মিছিল পথে বেরোল। তারই পাশাপাশি লাল ঝাণ্ডাকে সামনে নিয়ে শ্রমিকদের মিছিল চলে এলো। ছাত্র আর শ্রমিকদের শ্লোগানে শ্লোগানে বগুড়া শহরের রাজপথ আর অলি-গলি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এটা নতুন কিছু নয়, গত একমাস ধরে এমন মিছিল প্রায়ই বেরোয়। তাহলেও যারা মিছিলে নেমেছে তাদের মনের অবস্থা রোজকার দিনের মত নয়। আসন্ন ঝড়ের আভাস পেয়ে তাদের মনে আশঙ্কা-মিশ্রিত উত্তেজনা। খবর এসেছে ইয়াহিয়ায় সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ভেঙে গেছে। এবার এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘটনার গতি-প্রবাহে এক ভীষণ সংগ্রাম অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়বে।

সেই দিনই রাত দুটোর সময় খবর এসে পৌঁছল, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল সৈন্য বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এর তাৎপর্য সুস্পষ্ট, ওরা ওদের হিংস্র থাবা বিস্তার করে আক্রমণের জন্য ছুটে আসছে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে অঙ্কুরেই চূর্ণ করে ফেলবার জন্য ওরা ওদের এই অভিযান শুরু করেছে।

খবরটা দেখতে দেখতে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। ইতিমধ্যেই পথে পথে আওয়াজ উঠেছে, প্রতিরোধ চাই, প্রতিরোধ। ছাত্র আর শ্রমিকদের মিছিল বেরিয়ে গেছে। তারা সারা শহরের পথে পথে ঘুরে প্রতিরোধ সংগ্রামের আওয়াজ তুলছে। সেই আওয়াজে ঘরের মানুষ ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে।

শত্রুদের প্রতিরোধ করতে হবে। হ্যাঁ, প্রতিরোধ তো করতেই হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করবার মতো অস্ত্র কোথায়? ছাত্রেরা দল বেঁধে থানায় গিয়ে সেখান থেকে সমস্ত রাইফেল বের করে নিয়ে এলো। শুধু তাই নয়, শহরে যার যার হাতে যত বন্দুক ছিল, তার সবই তাদের হাতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় কোনোদিক থেকেই তারা বাধা বা আপত্তি পায় নি। সবাই যে যার বন্দুক তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ছাত্রেরা সেই সমস্ত অস্ত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। এই ক’দিনে তারা রাইফেল চালনার ব্যাপারে যে ট্রেনিং পেয়েছে তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। তা হোক, সংগ্রামে নেমে এসেছে, এখন আর অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার সময় নেই; তাদের যতটুকু বিদ্যা সেই টুকুকেই কাজে লাগাতে হবে।

সারা শহরের পথে পথে বহু ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। এই ব্যারিকেড গড়ে তোলার ব্যাপারে শত শত হাত অক্লান্ত ভাবে কাজ করে চলেছে। ছাত্র আর শ্রমিকরা সবাইর আগে, সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। হ্যাঁ, ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড তুলে ওদের চলার পথকে আটকে দিতে হবে, ওদের অচল করে ফেলতে হবে। বড় বড় গাছ কেটে শহরের প্রবেশ-মুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কাজের বিরাম নেই। এইভাবে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে এলো, তখনও কাজ চলছে। হ্যাঁ, সকল দিক দিয়ে ওদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে, ওদের আক্রমণকে অচল করে ফেলতে হবে।

সৈন্যরা মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়া শহরের দিকে মার্চ করে চলে আসছে। ওরা সকালবেলা বগুড়া শহরের সামনে এসে পৌঁছল। শহরে ঢোকার একমাত্র পথ সুবিলখালের পুল। ওরা সেই পথ দিয়েই চলে এলো। ছাত্র আর শ্রমিকরা সেখানে হানাদার শত্রু সৈন্যদের দৃষ্টির আড়ালে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা ব্যারিকেড সরিয়ে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আসছিল। গোপন আশ্রয়ের আড়াল থেকে ছাত্র আর শ্রমিকরা তাদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ছিল। হানাদার সৈন্যরা কালিতলাহাট হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে বড়গোলা মোড়ে আসে। এখানে আগে থেকেই অনেক ছাত্র পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা এখানে এসে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হলো। ফলে এখানে একজন কর্নেল সহ ১১ জন সৈন্য মারা যায়। সৈন্যরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এইভাবে পাক-সৈন্যরা অনেকক্ষণ ধরে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। বেলা যখন সাড়ে বারোটা তখন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র টিটু শত্রুসৈন্যের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মারা যায়। টিটু ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফিসের দোতালায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।

টিটু। মাত্র পনের বছর তার বয়স। বগুড়া শহরের স্কুলের ছাত্রদের সে ছিল নেতা। সবাই তাকে চিনত, জানত, সবাই তাকে ভালোবাসত। গত এক মাসের মুক্তি আন্দোলনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছিল। বীর কিশোর টিটু যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিল। শুধু সে-ই নয়, তারই মতো বগুড়ার আরও কয়েকটি বীর সন্তানকে সেদিন এই মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে। আজাদুর রহমান নামে এক তরুণ ইস্টার্ণ ব্যাঙ্কিং বিল্ডিং-এ আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করছিল। শত্রুর গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। আজাদ একটি প্রেস চালাত, তারই সাথে সাথে লেখাপড়াও করত। বগুড়ার মানুষ এই সমস্ত বীর শহীদের কথা ভুলে যেতে পারে নি। যুদ্ধের পরে টিটু আর আজাদের নামে এই মালতীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। আরও একজন শহীদের নাম এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। তার নাম হিরু। এই হিরুও সেদিন তাদেরই মতো যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিল। হিরু কিন্তু একজন বিহারীর সন্তান। বগুড়ার বিহারী কলোনীতে তার জন্ম, সেইখানেই সে বাস করত। তাহলেও জন্মভূমি বাংলাদেশকে সে তার মাতৃভূমি বলে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং এই মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে সে শাহাদত বরণ করল। বিহারী কলোনীর মধ্যেই হিরুর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। তার কবরের উপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন এবং তার নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।

টিটু, আজাদুর রহমান ও হিরুর মৃত্যুর পর পাক-সৈন্যরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে দক্ষিণদিকে এগুতে থাকে। একদল ঝাউতলার মধ্য দিয়ে যায়, আর একদল যায় রাজাবাজার দিয়ে। এরা রেললাইনের কাছে এসে গেলে ছাত্রেরা এদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এইভাবে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা বেলা দেড়টার সময় পেছনে হটতে থাকে। সৈন্যরা তাদের মনের ঝাল মেটাবার জন্য বেশ কিছু লোককে ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা এদের সবাইকে গুলি

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice