পাবনার মুক্তিযুদ্ধ
ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ২৫-এ মার্চ তারিখে পাবনা শহরে এসে ঢুকে পড়ল। শহরের মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। শীগ্গিরই এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যাবে, তারা মনে মনে এই আশঙ্কা করছিল। কিন্তু সেই ঘটনা যে এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে, সেটা তারা ভাবতে পারে নি। এই তারিখেই ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেটা গভীর রাত্রিতে। ওরা ২৫-এ মার্চ শেষ রাত্রিতে পাবনা শহরে এসে হামলা করল।
শহর থেকে মাইল চারেক দূরে হেমায়েতপুরের কাছে ইপসিক (ঊচঝওঈ)-এর অফিস। পাক-সৈন্যরা সেইখানে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসল। তারপর সেখান থেকে কিছু সৈন্য শহরে এসে ট্রেজারী দখল করে নিল। তাছাড়া ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র দখল করে বসল। তারা সারা শহরে কারফিউ জারী করে দিয়েছিল।
হামলাকারী সৈন্যরা শহরে এসেই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম. এল. এ. আমিনুদ্দীন সাহেব, ভাসানী-পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দার্ক্ষী এবং আরও কয়েক জন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করল। যারা ওদের হাতে ধরা পড়ল, শেষপর্যন্ত তাদের সবাইকে ওদের গুলির শিকার হয়ে মরতে হয়েছিল।
এর কয়েকদিন আগেই শহরের ডি. সি. ও এস. পি. স্থির করেছিলেন যে, শহর আক্রান্ত হলে তাঁরা প্রতিরোধ দেবেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে পুলিশ ব্যারাকের ১০০ জন সশস্ত্র পুলিশও মনে মনে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়ে ছিল। যতক্ষণ শক্তি আছে, ততক্ষণ এই শহরকে তারা পশ্চিমাদের হাতে ছেড়ে দেবে না। যেটুকু শক্তি আছে, তাই নিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়বে।
২৭-এ মার্চ তারিখে সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায়। এবং পুলিশদের অস্ত্রাগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশরা এতে অসামর্থ্য জানায় এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ডি. সি. তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তাঁর এই আদেশ কিছুতেই তারা অমান্য করতে পারবে না। এই নিয়ে দু’পক্ষে প্রথমে বাক-বিতণ্ডা এবং পরে গুলিবর্ষণ চলে। তখন বেলা শেষ হয়ে এসেছে। এই যুদ্ধে তিন জন্য সৈন্য মারা যায়। পাক-সৈন্যরা বাহাদুর পুলিশ ভাইদের হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু এ শিক্ষাও ওদের পক্ষে যথেষ্ট হয় নি। সেই রাত্রিতে তারা নতুন ভাবে আক্রমণ করবার জন্য তোড়জোড় চালাতে লাগল। রাত যখন সাড়ে চারটা, তখন ওরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে অতর্কিতে পুলিশ ব্যারাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু পুলিশ ভাইয়েরাও আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। সৈন্যরা যে আবার ফিরে এসে আক্রমণ করবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। এবার আর ব্যারাকে নয়, ব্যারাক ছেড়ে নিকটবর্তী বাড়িগুলির ছাদে এবং পথের মোড়ে মোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আড়াল নিয়ে হামলাকারী শত্রুদের জন্য বাঘের মত ওত পেতে বসে ছিল। তারা তো ছিলই, জেলখানার পুলিশ ভাইয়েরাও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। এইভাবে সারাটা রাত তারা শত্রুর জন্য মৃত্যু-ফাঁদ সাজিয়ে বসে ছিল। রাত সাড়ে চারটার সময় দু’পক্ষে সংঘর্ষ ঘটল। সৈন্যদের পরিবর্তে পুলিশরাই প্রথম আক্রমণ করল। এইভাবে অতর্কিতে চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ইয়াহিয়ার সুশিক্ষিত সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। এই সংঘর্ষে ১১ জন সৈন্য নিহত হবার পর বাকী সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল। পুলিশদের মধ্যে একজনও মারা যায় নি। সাবাস! পাবনার পুলিশ ভাইয়েরা!
২৭-এ মার্চ তারিখে পাবনা শহরের বুকে এ লড়াই শুরু হয়েছিল। ২৭-এ থেকে ২৯-এ, এই তিন দিন ধরে লড়াই চলল। ২৬-এ আর ২৭-এ এই দুই দিন ওরা শহরের উপর কারফিউ জারী করেছিল। তা-সত্ত্বেও ঐ অবস্থাতেই শহরের যুবক ও ছাত্রেরা ২৬-এ মার্চ, সারাদিন আর সারারাত প্রতিরোধের জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ একটি দিনের মধ্যে তারা বেশ কিছু অস্ত্র হাত করে নিয়েছিল। সেই একটি দিনে কারফিউ আইন-ভঙ্গকারীদের মধ্যে ৮/১০ জন সৈন্যদের গুলিতে মারা গিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধকারীদের মনোবল তাতে একটুও ভেঙে পড়ে নি।
পাবনা শহরের প্রতিরোধের ব্যাপারে ডি. সি.-র প্রথম থেকেই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ সাহেব আর তিনি মিলিটারির সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করে চলেছিলেন। তাঁরা দুই জন চর-অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং প্রতিরোধের ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন। মানুষ ভেতরে ভেতরে তৈরী হয়েই ছিল। তাঁদের এই আহ্বানে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে কৃষক এই হামলাকারী শত্রুদের খতম করে দেবার জন্য শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগল।
২৮-এ মার্চ। ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করে নিয়ে পাহারা দিয়ে চলেছিল। চরের কৃষকরা ছুটতে ছুটতে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল। তাদের হাতে লাঠি-সোঁটা, বর্শা-বল্লম, তীর-ধনুক আরও কত রকমের হাতিয়ার। ব্যারাক থেকে সকল পুলিশ চলে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া শহরের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এসে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। শেষপর্যন্ত জনতা প্রায় ১৫ হাজারে এসে দাঁড়াল। তাদের গগণবিদারী জয়ধ্বনিতে সারা শহর কেঁপে উঠল, থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যদের মন। এবার দু’পক্ষে গুলি-বর্ষণ চলল। সৈন্যদের হাতে মেসিনগান ও উন্নত ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র। পুলিশরা শুধু রাইফেল নিয়েই লড়ছিল। জনতার মধ্যে যাদের হাতে বন্দুক ছিল, তারাও সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সৈন্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুরক্ষিত আশ্রয়ে থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল। কাজেই সংখ্যায় কম হলেও তাদের খতম করে ফেলা সহজ কাজ ছিল না-ওদের মেসিনগানের অবিরল গুলিবর্ষণকে ভেদ করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতোই দুঃসাহসের কাজ।
সেই কারণেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। হাজার হাজার জনতা এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোনো কার্যকর সাহায্য করতে না পারলেও তাদের আকাশ-ফাটানো জয়ধ্বনি পাক-সৈন্যদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে তুলেছিল। তারা হতবুদ্ধির মত হয়ে গিয়েছিল। তাই উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র হাতে থাকলেও তারা তাদের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে নি। এমনি ভাবে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে এক এক করে তাদের ২৭ জনই মারা গেল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।
জয়োল্লাসে মেতে উঠল সারা শহরের মানুষ। বুড়ো থেকে বাচ্চারা পর্যন্ত আনন্দধ্বনি করতে করতে ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে। যে-সমস্ত সৈন্য ট্রেজারী ও শহরের অন্যান্য জায়গায় মোতায়েন ছিল, মুক্তিবাহিনীর প্রতি আক্রমণের সূচনাতেই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নিহত হয়েছে, বাকী সবাই পালিয়ে গিয়েছে। সারা শহরের পথে পথে জনতার বিজয়-মিছিল চলেছে।
শহর থেকে শত্রু সৈন্যরা নিহত ও বিতাড়িত হলেও শহর কিন্তু বিপদ্মুক্ত নয়। শহর থেকে মাইল চারেক দূরে ইপসিক (ঊচঝওঈ)-এর অফিস বাড়িতে শত্রু সেনার মূল বাহিনীর অধিকাংশ ঘাঁটি করে বসে আছে। তাদের সংখ্যা দেড় শতের মতো। সংখ্যার দিক দিয়ে যাই হোক না কেনো অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। শহরকে বাঁচাতে হলে তাদের রাহুগ্রাস থেকে শহরকে মুক্ত করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে এবং অনেকাংশে আজও যারা সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে, পাবনা জেলায় সেই ই. পি. আর. বাহিনীর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পুলিশ ভাইয়েরাই এখানকার একমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধা। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা খুবই দুর্বল। কাজেই হামলাকারী পাক-সৈন্যদের মূল ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেওয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এক্ষেত্রেও জনতাই সামনে এগিয়ে এলো।
পাবনা শহরের লড়াই-এর খবরটা শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইরের গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষক-সমিতির লোকেরা শহরকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছিল। তারা দলে দলে এসে শত্রুপক্ষের মূল ঘাঁটিকে ঘেরাও
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments