বরিশাল রণাঙ্গনে

পাক-সৈন্যরা বরিশাল জেলার উপর এসে হামলা করল অনেক পরে, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। বরিশাল জেলার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এই জেলার কোথাও রেলপথের যোগাযোগ নেই। প্রধানত জলপথের সাহায্যেই তাকে অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। একমাত্র ফরিদপুর জেলার সঙ্গে তার স্থলপথে যোগাযোগ রয়েছে। বরিশাল জেলায় আক্রমণ চালাতে হলে পাক-সৈন্যদের হয় নদীপথে, নয়তো স্থলপথে ফরিদপুর জেলার মধ্য দিয়ে আসতে হবে।

বরিশালের গৌরনদী থানা ফরিদপুরের সীমান্তবর্তী থানা। শত্রুরা যদি বরিশাল শহর দখল করবার জন্য স্থলপথে আসে, তবে তাদের এই থানা-অঞ্চলের উপর দিয়ে যেতে হবে; সুতরাং তাদের প্রতিরোধ করবার প্রথম দায়িত্ব গৌরনদী থানার অধিবাসীদের উপরই এসে পড়বে। শত্রুর হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার এই পবিত্র দায়িত্ব তারা কিছুতেই এড়াতে পারে না, এই অঞ্চলের কর্মীরা প্রথম দিকেই সে বিষয়ে সচেতন ছিল। এই উদ্দেশ্যে তারা গৌরনদীতে মুক্তিবাহিনীর একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। রাজনৈতিক কর্মী এবং ছাত্ররাই ছিল এই বাহিনীর মূল শক্তি। অস্ত্র বলতে তাদের হাতে ছিল কিছু-সংখ্যক বন্দুক ও রাইফেল। রাইফেলগুলি তারা গৌরনদী থানা থেকেই সংগ্রহ করে নিয়েছিল। জোর করে কেড়ে নিতে হয় নি, থানার অফিসাররা বিনা আপত্তিতে এই সমস্ত অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। শুধু থানা নয়, এই অঞ্চলের লোকদের হাতে যে বন্দুকগুলি ছিল, সেগুলিও মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গিয়েছে।

প্রথম আক্রমণ ২৫-এ মার্চ তারিখে, ঢাকা শহরে। তারপর থেকে ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তি-কামনাকে রক্তের ধারায় ধুইয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য বিদ্যুৎগতিতে জেলার পর জেলায় ধ্বংসের অভিযান চালিয়ে যেতে লাগল। এরপর বরিশালের পালা। সারা বরিশাল জেলার মানুষ সেই আসন্ন দুর্যোগের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষার দিনগুলি গুণে চলেছিল। হয় ওরা নদীপথে আসবে, নয়তো-স্থলপথে। আবার এমনও হতে পারে ওরা একই সঙ্গে দু’পথ দিয়েই আক্রমণ করে বসবে। স্থলপথে আক্রমণের প্রথম আঘাতের মোকাবিলা করতে হবে গৌরনদীকে। গৌরনদী সেজন্য প্রস্তুত আছে তো? মনের দিক থেকে তারা প্রস্তুত ছিল বটে, কিন্তু তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি যেটুকু ছিল, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য। মুক্তিবাহিনীর সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল, প্রথম ধাক্কাটা সামলাবার মতো শক্তি তার ছিল না।

অবশেষে সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটা নেমে এলো। খবর এসে পৌঁছল, ওরা আক্রমণ করবার জন্য স্থলপথ দিয়ে এগিয়ে আসছে। পাক-সৈন্যরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর শহর দখল করে নিয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ওরা মিলিটারি ভ্যান নিয়ে বরিশার জেলার সীমানায় এসে প্রবেশ করল। খবর পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করবার জন্য মুক্তিবাহিনী গৌরনদী থেকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। এদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ রাইফেল ট্রেনিং আর নির্ভীক দেশপ্রেম, এইটুকুকেই সম্বল করে তারা এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের মোকাবিলা করতে চলেছে।

বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তরেখায় ভূরঘাটা গ্রাম। পাক-সৈন্যবাহিনী বেলা এগারোটার সময় এই ভূরঘাটার সেতু পেরিয়ে ইল্লা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। দু’পাশের গ্রামবাসীদের মনে ত্রাস ও আতঙ্কের সঞ্চার করে ভ্যানগুলি গর্জন করে ছুটে আসছে। রাইফেল, মেসিনগান, মর্টার সবকিছুই আছে তাদের সঙ্গে। কুড়ি-পঁচিশটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় অশিক্ষিত একদল তরুণ তাদের প্রতিরোধ করতে চলেছে।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’টি তরুণ যুবক এই সীমান্ত এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করে চলেছিলেন। দু’জনেই কলেজের অধ্যাপক। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে এসেছেন। আজ সকল কর্তব্যের বড় কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়া। শত্রুসৈন্যরা-যে বরিশাল জেলার মাটির উপর এসে গেছে, এ খবরটা তখনও তাঁরা জানতে পারেন নি। আক্রমণ আসন্ন, ভূরঘাটা গ্রামের সেতুটাকে এখনই ভেঙে ফেলা দরকার। সেতুটাকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাঁরা দু’জন রিকশা-যোগে ভূরঘাটা গ্রামের দিকে চলেছিলেন। ইল্লা গ্রামে এসে পৌঁছতেই মিলিটারি ভ্যানের গর্জন শুনে চমকে উঠলেন তাঁরা। সরে পড়ার সময় ছিল না, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দ্রুত বেগে ছুটে আসা ভ্যানগুলি তাঁদের দৃষ্টিগোচরে এসে গেল। আর ঠিক সেই সময় একটা বুলেট তাঁদের দু’জনের মাঝখান দিয়ে রিকশাটার গা ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন রিকশা থেকে পথের দু’পাশে ছিট্কে পড়লেন। বরিশাল জেলার বুকে শত্রুপক্ষের এই প্রথম গুলিবর্ষণ।

তাঁরা দু’জন হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু সড়ক থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁদের ভাগ্য ভালো, তাঁরা শত্রুদের নজরে পড়ে যান নি। তাঁরা গুণে গুণে দেখলেন ১০টা ভ্যান, তার পেছনে একটা এ্যাম্বুল্যান্স গাড়ি। ভ্যানগুলি সম্ভবত গৌরনদীকে লক্ষ্য করে ছুটে চলে গেল। এঁরা দু’জন গ্রামের পথ ধরে পেছন পেছন ছুটলেন।

বার্থী গ্রামের সামনে গিয়ে ভ্যানগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একদল সৈন্য ভ্যান থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলল। যাকে সামনে পেল তাকেই মারল। তখন কালীপূজার সময়। ওরা পূজাবাড়িতে গিয়ে পূজায় রত দু’জন পুরোহিতকে হত্যা করল। এই পবিত্র কর্তব্য সুসম্পন্ন করে ভ্যানগুলি আবার তাদের গন্তব্য স্থলের দিকে যাত্রা করল।

বার্থী থেকে মাইল দুই দূরে কটকস্থল নামে একটি গ্রাম। মুক্তিবাহিনীর যে যোদ্ধারা শত্রু সৈন্যদের প্রতিরোধ করবার জন্য গৌরনদী থেকে যাত্রা করেছিল, তারা সেই সময় এই কটকস্থল গ্রামে পথের ধারে বসে বিশ্রাম করছিল। ভ্যানগুলি এগিয়ে আসতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দু’পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পেলো। পাক-সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে প্রথমেই গুলি ছুঁড়ল। প্রতিপক্ষ যে-কোনো সময় তাদের উপর এসে চড়াও হতে পারে, এমন একটা অবস্থার জন্য মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। সেজন্য তাদের মূল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু একটু বাদেই তারা তাদের পজিশন নিয়ে নিল। তারপর পরস্পর অজস্র ধারায় গুলি-বিনিময় চলল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু পাক-সৈন্যরা যখন ভারী মেসিনগান ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন রাইফেল-সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সামনে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীনও ছিল না। তারা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ পেছনে ফেলে রেখে গ্রামের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তাই বলে যুদ্ধটা একতরফা হয় নি। শক্তিশালী পাক-সৈন্যদেরও ক্ষয়-ক্ষতি হজম করে নিতে হয়েছিল। সত্য-মিথ্যা জানি না, লোকে বলে এই যুদ্ধে না কি আট জন পাক-সৈন্য নিহত হয়েছিল। তবে একথাটা সর্ববাদিসম্মত সত্য যে, ওদের সেই এ্যাম্বুল্যান্স গাড়িটা কতগুলি কাপড় দিয়ে ঢাকা মৃতদেহ নিয়ে মাদারীপুর শহরের দিকে ফিরে গিয়েছিল। তাদের সংখ্যাটা সঠিকভাবে বলার উপায় নেই।

এরপর পাক-সৈন্যরা তাদের মনের ঝাল মেটাবার জন্য মেসিনগান চালিয়ে সেই গ্রামের বহু নিরীহ লোককে হতাহত করল এবং তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিল। এইভাবেই বরিশাল জেলার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল।

কটকস্থল গ্রামের যুদ্ধের দিন কয়েক পরে। গৌরনদী পাক-সৈন্যদের দখলে এসে গিয়েছে। এখানকার ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়ে এবার তারা বরিশাল শহর দখলের অভিযানের জন্য তৈরী হচ্ছে। অপর দিকে বরিশাল শহরে মুক্তিবাহিনীও চুপ করে বসে নেই। হামলাকারী শত্রুদের প্রতিরোধ করবার জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা-অনুসারে কাজ করে চলেছিল।

বরিশাল শহরের মুক্তিবাহিনী গৌরনদীর মুক্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবলের দিক দিয়েই নয়, তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকও ছিল। ছাত্র ছাড়াও বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি নিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।

মুক্তিবাহিনীর নেতারা প্রতিরোধ-প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে এসে এক নতুন রণ-কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই তাঁদের প্রশংসা করতে হবে। সি এন্ড বি রোড বরিশাল শহরকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। শত্রুরা এই পথ দিয়েই বরিশাল শহর আক্রমণ করতে আসবে। তাদের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেবার জন্য

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice