মুক্তিযুদ্ধে ফেনী
২৫-এ মার্চ থেকে শুরু হলো ওদের আক্রমণ। ওদের নিশাচর বাহিনী গভীর রাত্রিতে অতর্কিতে ঢাকা শহরে হিংস্র বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল, সারা শহর রক্তের প্লাবনে প্লাবিত করে দিল। সেই আক্রমণের ঢল দ্রুতবেগে নেমে এলো, দেখতে দেখতে সারা প্রদেশময় ছড়িয়ে পড়ল। এই ধরনের পৈশাচিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। ওদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াবার মতো প্রস্তুতিও গড়ে ওঠে নি। ওরা ধ্বংসের আগুনে শহরের পর শহর আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে করতে এগিয়ে চলল। ওদের কামান, মেসিনগান আর আধুনিক যুগের উন্নত ধরনের মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে যা দিয়ে লড়াই করবে, এমন কি হাতিয়ার আছে জনসাধারণের হাতে?
তাহলেও বিদ্রোহী বাঙালি এই হিংস্র দস্যুদের কাছে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করল না। স্বাধীনতা অর্জনের দুর্জয় সঙ্কল্প আর দুরন্ত মনোবল, তাই নিয়ে তারা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। এই সর্বগ্রাসী ধ্বংসের মধ্য দিয়েই বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ-শক্তি ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে লাগল। ‘দুর্বল বাঙালি, ভীতু বাঙালি’ বলে যাদের বিরুদ্ধে এতোকাল ধরে অবাধে প্রচার চালিয়ে আসা হয়েছে, তারাই আজ কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেদের সত্যিকারের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে চলল। সেদিন শহরে আর গ্রামাঞ্চলে প্রতিরোধের যে-স্ফুলিঙ্গগুলি দেখা দিয়েছিল, আজ এই ক’টি মাসের মধ্যে তারা ব্যাপক অগ্নিশিখার রূপ নিয়ে আক্রমণকারী দস্যুদের ঘেরাও করে ফেলেছে। শেষ-পর্যন্ত এই আগুনেই ওদের জ্বলেপুড়ে মরতে হবে।
এপ্রিলের প্রথমভাগেই নোয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক ও নায়ক। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, সাধারণ মানুষ, এরা সবাই এই বাহিনীতে সামিল হয়েছিল। হাতিয়ার বলতে এদের ছিল কিছু রাইফেল আর বন্দুক, তাছাড়া বর্শা, বল্লম, লাঠি-সোঁটা ইত্যাদিও ছিল। এই অস্ত্র সম্বল করে, সবকিছু জেনেশুনেও তারা কামান, মর্টার আর মেসিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তৈরী হয়েছিল। তখন তারা ভাবতেও পারে নি যে, এর চেয়েও মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে ওরা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু যখন সে সময় এলো, তখন তাতেও পেছ-পা হয় নি তারা। সেই কাহিনী বলতে যাচ্ছি।
মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি নেবার জন্য বেশী সময় পায় নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই আক্রমণকারী পাক-সৈন্যের একটা দল ফেনী শহর দখল করবার জন্য মার্চ করে এগিয়ে এলো। কিন্তু কাজটাকে যত সহজ বলে মনে করেছিল, তা-যে ঠিক নয় কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। ওরা ফেনী শহরে এসে পৌঁছবার আগেই মুক্তিবাহিনী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। যাকে বলে মুখোমুখি লড়াই তা নয়, মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আপনাদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে এমনভাবে অস্থির করে তুলল যে, শেষপর্যন্ত ওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছনে হটে যেতে বাধ্য হলো। এই গেল প্রথম রাউন্ড। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো না। এরপর দু’পক্ষের মধ্যে পরপর কয়েকবার সংঘর্ষ ঘটল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে আক্রমণকারীদের মুখ চুণ হয়ে গেল। এই দুর্গম পথে, এই জীবনপণ করা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়, আর তা করতে গেলে যথেষ্ট ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই সত্যটা-সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মতো স্থলপথে আক্রমণের কাজটা স্থগিত রাখল।
এই ভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ মেজর জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একথা ভালোভাবেই জানতেন, যুদ্ধের এইখানে ইতি নয়, সূচনা মাত্র। ওরা শীঘ্রই শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে আসবে। আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই, এবার প্রবলতর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সেজন্য ভয় করলে চলবে না। শত্রু যতই প্রবল হোক না কেনো, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হবে, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করেছে। ফেনী শহর ও নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লাঠির ঘায়ে পিছিয়ে গিয়ে জঙ্গীবাহিনীর নেতারা ফেনী শহরকে আক্রমণ করার জন্য এবার এক নতুন পরিকল্পনা তৈরী করল। এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ। একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে দু’টো বিমান প্রচণ্ড গর্জন তুলে সারা শহরটাকে প্রদক্ষিণ করে চলল। ওরা শুধু অবস্থা-পর্যবেক্ষণ করতেই আসে নি, বোমারু বিমান দু’টো ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর উপর বোমা ফেলে চলেছে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সাধারণ মানুষ এমন একটা আকস্মিক ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। কিছু কিছু লোক হতাহতও হলো। এই ভাবে কিছুক্ষণ বোমা ফেলে বিস্ফোরণ ঘটাবার পর সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবগুলি স্বস্থানে ফিরে গেল।
পরদিন আবার ওরা এলো। এসেই আগেকার দিনের মতোই বোমা ফেলে চলল। কিন্তু একটি দিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শহরের সাধারণ মানুষ অনেক বেশী সাহস সঞ্চয় করেছে। বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে কি করে আত্মরক্ষা করতে হয় সেই কৌশলটাও তারা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারা দিগ্বিদিক্ জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিল না, অথবা বহু লোক এক জায়গায় ভীড় করে দাঁড়িয়ে ওদের হাতে আক্রমণের সুযোগ তুলে দিচ্ছিল না, তারা ঠাণ্ডা মাথায় আত্মরক্ষা করে চলেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধারা? মুক্তিযোদ্ধারা কি করছিল?
সেই ধ্বংসলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেজর জিয়া নির্ভীক কণ্ঠে হেঁকে উঠলেন, মুক্তিবাহিনীর জওয়ান ভাইরা, আমরা মরবার জন্য তৈরী হয়েই এই দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, তবে আর আমাদের ভয় কি! কুছপরওয়া নেই, আমরা ঐ বিমান দু’টোকে পাল্টা আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে ছাড়ব।
মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করল, আমাদের হাতে তো এন্টি এয়ারক্র্যাফ্ট্ কামান নেই, আমরা কেমন করে এই বিমানগুলিকে ধ্বংস করব?
হ্যাঁ, এন্টি এয়ারক্র্যাফ্ট্ থাকলে আমরা আগেই ওদের দফা রফা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নাইবা থাকল তা, আমাদের রাইফেল তো আছে। এই রাইফেল দিয়েই আমরা ওদের এমন শিক্ষা দেব, যা ওরা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। জওয়ান ভাইসব, শহরে যে-সমস্ত উঁচু দালান আছে, তাদের উপর উঠে ওদের তাক করে গুলি চালাতে থাক। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা এইভাবে শত শত মার্কিন জঙ্গী বিমান ফেলে দিয়েছে, আমরাই বা কেনো পারব না? এক মুহূর্ত দেরী নয়, জওয়ান ভাইরা, ছুটে চল সবাই।
শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, মেজর জিয়া সবার আগে নিজেই রাইফেল বাগিয়ে ছুটলেন। রাইফেলধারী যোদ্ধারা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ছুটতে ছুটতে শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলির ছাদে গিয়ে উঠে পড়ল। এই দালানগুলি যে-কোনো সময় বোমার আঘাতে ধসে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেজন্য মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, বিন্দুমাত্র ভয় নেই। সবাই একমনে বিমান দু’টোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে চলেছে। তাদের-যে এভাবে আক্রান্ত হতে হবে, বিমান-চালকরা একথা কল্পনাও করতে পারে নি। তাই তারা নিশ্চিত মনে রাইফেলের নাগালের ভেতরে এসে গিয়েছিল। তারা জানত যে, সে ক্ষেত্রে তারাই শুধু আক্রমণকারী। কিন্তু তারাও-যে আক্রান্ত হতে পারে, এটা তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা দালানের ছাদের উপর থেকে প্রায় একই সঙ্গে এক ঝাঁক রাইফেলের গুলি ছুটল। আর একই সঙ্গে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা উল্লাসধ্বনি করে উঠল। একটা বিমানে আগুন ধরে গেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। জ্বলন্ত বিমানটার অবস্থা দেখে অপর বিমানটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, দেখতে দেখতে আকাশপথে মিলিয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ বিমানটা উল্কার মত জ্বলতে জ্বলতে পুবদিকে ছুটল। ওটা একটু বাদেই জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। পরে জানা গিয়েছিল, জ্বলন্ত বিমানটার ধ্বংসাবশেষ ত্রিপুরার সীমান্তে গিয়ে পড়েছিল।
জয়, মুক্তিবাহিনীর জয়! জয়, স্বাধীন বাংলার জয়! বিজয়-গর্বে উদ্দীপ্ত হাজার হাজার জনতার
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments