যশোর রণাঙ্গনে
মুক্তি-আন্দোলনের ঊর্মিমুখর প্রবাহে সারা যশোর জেলা চঞ্চল আর উচ্ছল হয়ে উঠেছে। ছাত্র, যুবক, কৃষক, সাধারণ মেহনতী মানুষ সবাই এগিয়ে এসেছে। ই. পি. আর., পুলিশ, আনসার তারাও পিছিয়ে থাকে নি।
২৩-এ মার্চ তারিখে ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানরা তাদের ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলল, আর সেই পতাকার সামনে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ‘গার্ড অব অনার’ দিলো। অবাঙালিরা প্রতিবাদ তুলেছিল, কিন্তু তাদের এ আপত্তি টিকল না। ২৫শে মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়ার জঙ্গী-বাহিনীর বর্বর আক্রমণের খবর যখন এসে পৌঁছল, যশোরের মানুষ তাতে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, ক্রোধে গর্জন করে উঠল-এর উপযুক্ত প্রতিশোধ চাই। যশোর ক্যান্টনমেন্টে কামান, মর্টার আর মেসিনগানে সজ্জিত হাজার হাজার পাক-সৈন্য মোতায়েন হয়ে আছে, যে-কোনো সময় তারা অগ্নিস্রাবী প্লাবন নিয়ে নেমে আসতে পারে, এ কথা চিন্তা করেও তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল না। ২৬, ২৭ ও ২৮-এ মার্চ, এই তিন দিনে ই. পি. আর.-এর চারটি ক্যাম্পে জওয়ানরা প্রতিরোধের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প নিল।
প্রথম সংঘর্ষ ঘটল ২৯শে মার্চ তারিখে। শহরের উপর নয়, শহর থেকে বাইরে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। সেদিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। দিনের অবস্থা বদলে গেছে, মুক্তি-আন্দোলনের হাওয়া ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও এসে ঢুকেছে-নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এর পরিণাম কি হবে, তা তারা ভালো করেই জানত; তা-সত্ত্বেও এই লাঞ্ছনাকে তারা নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নেয় নি।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ওরা আগেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের ম্যাগাজিনের চাবিটা কেড়ে নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা তাতেও দমল না, তারা ম্যাগাজিন ভেঙে কিছু অস্ত্র বার করে নিয়ে এলো। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। একদিকে কামান, মর্টার, মেসিনগান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য, অপর দিকে হালকা হাতিয়ার সম্বল করে এক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্য। এই যুদ্ধ কতক্ষণ চলতে পারে! স্বাভাবিকভাবে এই সংঘর্ষে বহু বাঙালি সৈন্য মারা গেল। বাকী সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে ক্যান্টনমেন্টের বন্ধ দরওয়াজা ভেঙে বাইরে পালিয়ে গেল।
এই সংবাদ দেখতে দেখতে শুধু যশোর শহর নয়, সারা যশোর জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল, এবার মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আর বসে থাকার সময় নেই। ই. পি. আর. বাহিনী আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি হয়ে ছিল। এবার শহরের পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এই পুলিশ-বিদ্রোহে যাঁরা নেতৃত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হচ্ছেন হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন আর পীযুষ। শহরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে হিমাংশু ব্যানার্জী শুধু পুলিশদের মধ্যে নয়, শহরের সাধারণ লোকের মধ্যেও জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয় খেলোয়াড়টি এবার এক নতুন খেলায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন।
পুলিশ ম্যাগাজিনের চাবি ছিল অবাঙালি জমাদারের হাতে। হিমাংশু, আকমল আর পীযুষ তাকে বন্দী করে তার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। সেখান থেকে তাঁরা সাত শ রাইফেল, ছয় শ সটগান, কিছুসংখ্যক ব্রেনগান এবং যথেষ্ট পরিমাণে কার্তুজ উদ্ধার করলেন। তারপর এই অস্ত্রগুলিকে বিদ্রোহী পুলিশ আর বিদ্রোহী জনতার মধ্যে বিলি করে দেওয়া হলো। কিন্তু শুধু অস্ত্র দিলেই তো হয় না, অস্ত্র চালনায় অশিক্ষিত জনতা অস্ত্র দিয়ে করবে কি? স্থির হলো, এদের এখনই অস্ত্র-চালনা শিক্ষা দিতে হবে। মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য ব্যগ্র পুলিশ আর জনতা নিউ টাউনের নোয়াপাড়ার আমবাগানে ঘাঁটি করে বসেছিল। এখানে জনতার মধ্য থেকে তিন শ জনকে বাছাই করে নিয়ে ষাট জন পুলিশ তাদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দিলো। মাত্র এক ঘণ্টার মতো সময় পেয়েছিল তারা। এইটুকু সময়ের মধ্যেই তারা রাইফেল চালনার অ, আ, ক, খ টুকু আয়ত্ত করে নিল।
সেদিন সেই আমবাগানেই এই নবদীক্ষিত শত শত মুক্তি-যোদ্ধাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। জন-সাধারণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আহার্যদ্রব্য যোগাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই স্মরণীয় আমবাগানের মধ্যে তাঁদের এই মুক্তিসংগ্রামী ভাইদের জন্য রান্না করছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবিকা নারী বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন হিমাংশু ব্যানার্জীর স্ত্রী।
সেইদিনই ই. পি. আর. বাহিনী, ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’শর উপরে সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হলো। ক্যান্টনমেন্ট থেকে চারটি সৈন্যবাহী জিপ সম্ভবত শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বেরিয়েছে। মুক্তিবাহিনী তাদের মধ্যে তিনটি জিপকে খতম করে দিলো। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম শুরু। সেদিন রাত দু’টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের শালতলা এলাকায় পাক-সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচুর গুলিবিনিময় হয়।
সেই রাত্রিতেই যশোর জেলের কয়েদীরা বাইরের খবর শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা জোর করে জেল থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং তাই নিয়ে জেল-প্রহরীদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এবং গুলি চলে। শেষপর্যন্ত তার পরদিন রাত্রিতে সেখানকার ১৩৭৫ জন বন্দী জেলের দরওয়াজা ভেঙে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সতেরোজন ছিলেন নিরাপত্তা বন্দী। এটা ৩০ তারিখ রাত্রের ঘটনা।
৩০শে মার্চ ভোরবেলা দু’দল পাক-সৈন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে জিপে করে দু’দিকে যাত্রা করল। একদল এখানকার চাঁচড়ার দিকে, আর একদল খুলনার দিকে। মুক্তিবাহিনীও দু’দলে ভাগ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাক-সৈন্যদের মধ্যে যে-দলটি খুলনার দিকে যাত্রা করেছিল, পুরাতন কসবার পুলের কাছে তাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষে পুলিশদের নেতা হিমাংশু ব্যানার্জী শহীদ হলেন। চাঁচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে আচ্ছামত ঘা খেয়ে পাক-সৈন্যরা ভীতত্রস্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়লো। মুক্তিবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রইল।
৩১শে মার্চ তারিখে শহর থেকে চার মাইল দূরে যশোর-মাগুরা রোডের ধারে হালিমপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-সেন্টার খোলা হলো। ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানদের নেতৃত্বে এই ট্রেনিং দানের কাজ চলবে। শোনা যায়, জেল ভেঙে বেরিয়ে আসা প্রায় পাঁচ শ জন কয়েদী স্বেচ্ছায় এই ট্রেনিং-সেন্টারে যোগ দিয়েছিল।
কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রামের এই সমরসজ্জা শুধু যশোর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রায় একই সাথে মহকুমা শহরগুলিতেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল। নড়াইলের এস. ডি. ও. এবং সেখানকার বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। যশোর শহরে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, এই খবর পেয়ে তারা শত্রুদের আক্রমণ করবার জন্য যশোর শহরের দিকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। নড়াইল মহকুমার হাজার হাজার লোক যার হাতে যা হাতিয়ার ছিল তাই নিয়ে এই যুদ্ধ-মিছিলে যোগ দিল। যশোর-নড়াইল রোডের দু’ধারের গ্রামগুলি তাদের ঘন ঘন জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগল।
নড়াইল মহকুমার লোহাগাড়া অঞ্চলেও একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নৌ-বিভাগের প্রাক্তন অফিসার শামসুল আলমের উদ্যোগে এই শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীটি গড়ে উঠেছিল। শামসুল আলম সামরিক চাকরি থেকে অবসর-গ্রহণের পর একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে আর দশজনের মতই সংসার-জীবন যাপন করে চলেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আহ্বানে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি তাঁর চাকরির মায়া ছেড়ে দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে তাঁর নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ শ যোদ্ধার এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। এই মুক্তিবাহিনীর জন্য থানা থেকে ও বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে দু’শর উপরে রাইফেল ও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল।
যশোর শহরের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহাগড়ার এই মুক্তিবাহিনীও যশোরের দিকে দ্রুত মার্চ করে চলল। শামসুল আলম নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরী করে তুলেছিলেন। এখানেও হাজার হাজার লোক তাদের যুদ্ধযাত্রার সাথী হয়েছিল। তারা তাদের ভীমগর্জনে পথ-ঘাট মুখরিত করতে করতে যুদ্ধের
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments