বদরুদ্দিন তায়াবজী
জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। কিন্তু নিজেদের ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞতার ফলে এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের ত্রুটি বিচ্যুতির দরুণ এই সমস্ত নাম বিস্মৃতির তলায় চাপা পড়ে যায়। এমনি একটি নাম বদরুদ্দিন তায়াবজী। ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টদের নামের ধারাবাহিক তালিকায় তাঁর নামটা খুঁজে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তাঁর দেশের মানুষ তার সর্ম্পকে খুব কম খবরই রাখে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যখন প্রথম গঠিত হয়, সে সময় যে ক’জন নেতৃস্থানীয় মুসলমান তার সঙ্গে যোগদান করেন, নিঃসন্দেহে বদরুদ্দিন তায়াবজী তার মধ্যে প্রধান। তিনি সে সময় ভারতের একজন বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী মুসলমান হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এটা এখনকার মুসলমান সমাজ তথা সমগ্র দেশবাসীর পক্ষে দুর্ভাগ্যের কথা যে, সেই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানকারী স্বল্প সংখ্যক মুসলমান নেতা ও কর্মীদের এই বিচিত্র নামের এক বিশেষ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কে অজ্ঞতা, অবিশ্বাস ও বিরোধ এবং সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রদায়িক কূটনীতি এর জন্য দায়ী। যে সমস্ত মুসলমান নেতা ও কর্মী জাতীয়তাবাদী নীতিকে ভিত্তি করে কংগ্রেসে যোগ দিতেন, নিজেদের সম্প্রদায় থেকে তাঁদের বহু বাধা ও বিরোধিতার সম্মখীন হতে হয়েছে। বদরুদ্দিন তায়াবজীকেও ‘বীরের মতো’ এই বিরোধিতাকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
বদরুদ্দিন তায়াবজী বোম্বাইয়ের একজন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার ছিলেন। কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় তিনি ছিলেন তখনকার দিনের সারা ভারতের অন্যতম প্রধান জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি শৈশবে তাঁদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী মুসলমানী মাদ্রাসায় পড়েছিলেন। তারপর বোম্বাইয়ের এলফিন্ স্টোন্ ইনস্টিটিউট কলেজে শিক্ষালাভ করেন। লর্ড লিটন কর্তৃক ১৮৭৮ সালে ‘ভার্ণাকুলার প্রেস এ্যাক্ট’ ঘোষণার পর থেকেই তিনি রাজনীতি চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৮৮৩ সালে যখন সারা দেশে ইলবার্ট বিল নিয়ে বিতর্ক বাঁধল তখন তিনি এই বিলের প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছিলেন।
এখানে ভার্ণাকুলার প্রেস এ্যাক্ট ও ইলবার্ট বিল সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার। গত শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় সংবাদপত্রের শক্তি ও প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলেছিল। অনেক সময় নির্ভীকভাবে সরকারের কাজের সমালোচনা করত এবং তার প্রতিক্রিয়া জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। তাদের এই সমালোচনার ফলে সরকার বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে যখন বরদার মহারাজা মল্হার রাও গাইকোয়াড়কে গদিচ্যুত করা হলো, তখন বোম্বাই-এর ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকা সরকারের এই কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। পত্রিকাটিতে এ পর্যন্ত বলা হয়েছিল যে সরকার এ কাজ করে তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন, অতঃপর দেশীয় পত্রিকাগুলিকে শায়েস্তা করবার জন্য ভারত সরকার নানা ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। কিন্তু প্রচলিত আইনের সাহায্যে তাদের দণ্ডিত করা সম্ভব হলো না।
এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য বড়লাট লর্ড লিটন ১৮৭৮ সালে ‘ভার্ণাকুলার প্রেস এ্যাক্ট’ নামে বিশেষ আইন পাশ করিয়ে নিলেন। এই আইনের বিধান অনুযায়ী পত্রিকা স¤পাদকের এই মর্মে কথা দিতে হবে যে তারা কোনরকম আপত্তিজনক প্রবন্ধ বা লেখা প্রকাশ করবেন না। নয়ত লেখা প্রকাশের পূর্বে তা সংশ্লিষ্ট ও সরকারী কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে নিতে হবে। এই আইনের বিরুদ্ধে দেশীয় সংবাদপত্র মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ উঠলো। শুধু সংবাদপত্র নয়, এই নিয়ে সারা দেশে একটি ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়।
এখানকার এই আন্দোলনের প্রতিধ্বনি ইংলণ্ডে গিয়ে পৌঁছল। সে সময় সরকার পরিচালনার ভার কনজার্ভেটিভ পার্টির হাতে। লিবারেল পার্টি এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অতঃপর দেশের শাসন ক্ষমতা লিবারেল পার্টির হাতে চলে যাবার পর ১৮৮২ সালে এই আইনটিকে বাতিল করে দেওয়া হলো। ভার্ণাকুলার প্রেস এ্যাক্ট এর গোলমালটা মিটে যাবার পরই আর একটা গুরুতর সমস্যা দেখা দিলো। সে সময় ভারতের বড়লাট ছিলেন রিপন। ভারতীয় প্রজারা যাতে ন্যায়সঙ্গত আচরণ পায়, তিনি সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। আইনসচিব (খধি সবসনবৎ) স্যার কোর্টনি ইলবার্ট এই মর্মে এক বিল আনয়ন করলেন যে, ভারতীয় জজদের একমাত্র ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজা ছাড়া আর সমস্ত ভারতীয় নাগরিকদের বিচার করবার অধিকার থাকবে। ইতিপূর্বে কৃষ্ণাঙ্গ জজদের শ্বেতাঙ্গদের বিচার করবার কোনো অধিকার ছিল না। এই বিলটি উত্থাপনের সাথে সাথেই সমগ্র এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায় এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। ‘ইলবার্ট বিল’ নামে খ্যাত এই বিলটিকে প্রতিরোধ করবার জন্য তারা প্রতিরক্ষা তহবিল (উবভবহপব ঋঁহফ) গঠন করল এবং এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পত্রিকাগুলি এর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল। শুধু তাই নয়, এর বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ হয়ে লড়বার জন্য তারা লণ্ডনে এজেন্ট পাঠিয়ে দিল। লণ্ডনেও এই নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল। তখন ‘লিবারেল পার্টির’ সরকার দেশ শাসন করেছিল। এই বিলের পিছনে লিবারেল পার্টির সমর্থন ছিল। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ কনজারভেটিভ পার্টি এবং বলতে গেলে প্রায় সমগ্র ইংরেজ সমাজ প্রস্তাবিত বিলটির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চালান। কৃষ্ণাঙ্গ বিচারপতিদের দ্বারা শ্বেতাঙ্গদের বিচার করার মধ্য দিয়ে তাদের মর্যাদাহানি ঘটবে, এই অবমাননা তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। এই আন্দোলনের চাপে লিবারেল পার্টিকে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হলো এবং শেষ পর্যন্ত ইলবার্ট বিলকে সংশোধন করা ছাড়া গত্যন্তর রইল না।
উপরোক্ত ভার্ণাকুলার প্রেস এ্যাক্ট ও ইলবার্ট বিলের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বদরুদ্দিন তায়াবজী রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন, এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হিসাবেও সুপরিচিত হয়ে উঠলেন। শুধু বোম্বাই প্রদেশে নয় সমস্ত ভারতবর্ষে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁকে বোম্বাইএর লেসিজলেটিভ কাউন্সিলের অতিরিক্ত সভ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি এসোসিয়েশন গঠিত হয়। এই এ্যাসোসিয়েশনের সভায় দাঁড়িয়ে তিনি সুষ্পষ্ট ভাষায় তাঁর এই রাজনৈতিক অভিমত ব্যক্ত করেন:
‘‘আমার মতে রাজনৈতিক জীবনের প্রসারের সাথে সাথে ব্যক্তিগতভাবে ও জাতিগতভাবে নূতন নূতন আকাঙ্খার স্ফুরণ হতে থাকে। এবং এই আশা আকাঙ্খাকে যথোচিতভাবে প্রকাশ করার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজন হয়। আবার এই সংগঠন সেই সমস্ত জাতীয় আশা আকাঙ্খার দিকে দৃষ্টি রাখে, তাদের নিয়ন্ত্রণ ও বিকাশ সাধন করে এবং যথোচিতভাবে পথে পরিচালিত করে।” এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার সর্ম্পকে সচেতন হয়ে উঠেছি এবং জাতি বর্ণ ও ধর্মের বিভিন্নতা এতকাল আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে ক্ষতিকর পার্থক্যের সৃষ্টি করে এসেছে শিক্ষার প্রভাবে তা এখন বিদূরিত হয়ে গেছে।”
১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে যখন বোম্বাই শহরে কংগ্রেসের উদ্বোধনী সভা অনুষ্ঠিত হলো তখন বদরুদ্দিন তায়াবজী তার প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানালেন। ‘লণ্ডন টাইমস’পত্রিকা এই বলে মন্তব্য করল যে, বোম্বাইয়ের মুসলমানরা এই সভায় যোগদান করেনি। তখন তিনি তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করে পাঠালেন। এ সর্ম্পকে তিনি বোম্বাই প্রেসিডেন্সি এ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় বলেছিলেন, আমি আপনাদের এই আন্দোলন সম্পর্কে আমার ও আমার মুসলমান ভাইদের সহানুভূতি জানাচ্ছি। লণ্ডনের টাই্মস পত্রিকা এই আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করেছে যে, বোম্বাইয়ের মুসলমানেরা এ ব্যাপারে কোনরূপ অংশগ্রহণ করেনি। আমি সেই সভায় উপস্থিত থাকতে পারিনি একথা সত্য, কিন্তু তা হলেও রহমতুল্লা সায়ানি আবদুল্লার মত বিশিষ্ট মুসলমান নেতারা এই সভায় যথারীতি অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তায়াবজী পুনরায় এ সম্পর্কে তার অভিমত জানিয়ে বলেছিলেন সরকারের কাছে তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের অভাব অভিযোগ জানিয়ে এবং তাদের নিজেদের দেশের রাজনৈতিক উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্য দেশের অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রাদায়-এর লোকেদের সাথে মিলিতভাবে আন্দোলন করতে রাজী হবে না, আমি এ কথার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
মুসলমানরা যাতে কংগ্রেসে যোগদান না করে বোম্বাইয়ের গভর্নর লর্ড রে সে বিষয়ে চেষ্টা করে দেখেছিলেন। বড়লাট লর্ড ডাফরিন ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে স্যার সৈয়দ আহমদকে নিজেদের হাতের মুঠোর মধ্যে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments