স্বদেশী আন্দোলনের তিন পুরুষ
মওলবী লিয়াকত হোসেন
আজকের দিনে এই নামটি খুব কম লোকের কাছেই পরিচিতি। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ নামটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। বস্তুতঃ লিয়াকত হোসেন বাঙালী নন তাঁর জন্ম হয়েছিল বিহারে। তা হলেও বাংলাদেশকে তিনি জন্মভূমির মতোই আপন বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। আমরা বাঙালিরাও যেন সেই দৃষ্টি নিয়ে তাঁকে দেখতে পারি।
মৌলবী লিয়াকত হোসেন এর প্রাথমিক জীবন সম্বন্ধে আমাদের কোনো কিছুই জানা নেই। একজন উদ্যোগী ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসাবেই তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ১৯০৫ সালের কথা। সে সময় বড়লাট লর্ড কার্জন নবজাগ্রত বাঙালী শক্তিকে নিষ্পেষিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গভঙ্গের বিধান জারি করেছিলেন। বাংলাদেশ নিঃশব্দে মেনে নেয়নি। এই ‘‘ঝবঃঃষবফ ভধপঃ ঁহংবঃঃষবফ’’-করে দেবার জন্য বাংলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিবাদের তুমুল ঝড় উঠেছিল। সেই তাণ্ডবের সময় জনসাধারণকে পথ প্রদর্শন করার জন্য যাঁরা পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মৌলবী লিয়াকত হোসেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনায় সে যুগের বাংলার একচ্ছত্র নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর প্রভাব পড়েছিল। পরে তিনি অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন।
সে যুগে যে সমস্ত মুসলমান নেতা ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ নীতি প্রতিরোধ করে চলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে লিয়াকত হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলাদেশের মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে ১৯০৫ সালের ২২শে অক্টোবর তারিখে প্রচারিত কুখ্যাত ‘কারলাইল সারকুলারের’ বিরুদ্ধে এবং স্বদেশী আন্দোলনের সপক্ষে অক্লান্ত হয়ে প্রচারকার্য চালিয়ে গিয়েছিলেন।
শুধু রাজনৈতিক হিসাবেই নয় সামাজিক সংস্কার সাধনের দিক দিয়েও তাঁর অবদান বড় কম নয়। প্রচলিত অর্থে যাদের ‘শিক্ষাবিদ’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে প্রকৃতপক্ষে লিয়াকত হোসেন তা ছিলেন না। তা হলেও দেশের অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি তাঁর সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে গেছেন। সামাজিক সংস্কার ও জনহিতকর কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৯১৬ সালে ‘ভারত হিতৈষী সভা’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। জাতি ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে দরিদ্র জনসাধারণকে নানাভাবে সাহায্য করাই ছিল এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য। মৌলবী লিয়াকত হোসেন ছিলেন এই সমিতির সভাপতি। এই সমিতি দরিদ্র ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষালাভের ব্যাপারে সাহায্য দান করত। সে যুগে হিন্দুদের মধ্যে নিষ্ঠুর পণপ্রথা সমাজের অভিশাপ স্বরূপ ছিল। ফলে দরিদ্র সংসারগুলিতে মেয়েদের পাত্র জোটানো এক কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাবা-মাদের এই নিদারুণ সমস্যার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য কত কুমারী মেয়ে আত্মহত্যার পর্যায় তাদের কিশোরী জীবনের ছেদ টেনে দিয়েছে। লিয়াকত হোসেনের ‘ভারত হিতৈষী সভা’ মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও গরীব পরিবারগুলিকে অর্থ সাহায্য করত। সমিতির এই সমস্ত কাজের পিছনে তিনিই ছিলেন মূল প্রাণশক্তি। একজন অবাঙালি মুসলমান যে বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সমাজের জন্য এমন দরদ দিয়ে চিন্তা করতে পারে এবং তাদের সেবায় আপনাকে প্রাণ ঢেলে উৎসর্গ করতে পারে, আমাদের পক্ষে এটা কল্পনাতীত। মৌলবী লিয়াকত হোসেন ছাড়া আর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু এটা স্মরণ রাখতে হবে, লিয়াকত হোসেন ছিলেন মূলতঃ রাজনৈতিক কর্মী। বিদেশী ইংরেজদের শাসনপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে অক্লান্ত কাজের মধ্য দিয়ে তিনি তার সেই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করে চলেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে অনুসরণ করে চলেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে সুরেন্দ্রনাথের নরমপন্থী নীতির প্রতি হতশ্রদ্ধ হয়ে নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী চরমপন্থী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, ১৯০৫-০৮ সালের স্বদেশী আন্দোলনে যে সমস্ত মুসলমান কর্মী ও বক্তা আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন লিয়াকত হোসেনকে তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বলা চলে। সেই সময়কার বিখ্যাত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় তাঁর প্রশংসনীয় কার্যাবলীর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের কাজ ছাড়াও ১৯০৮ সালে বরিশালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অশ্বিনীকুমারের সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি অ্যান্টি সারকুলার সোসাইটির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯০৬-০৭ সালে নরমপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর তিনি বিপিন পাল ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখ চরমপন্থী নেতাদের সঙ্গে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন। এই সময় কিছুকালের জন্য ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা অফিসটাই ছিল তাঁর আস্তানা।
মৌলবী লিয়াকত হোসেন তাঁর স্বদেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু এই স্বদেশ শুধু তাঁর দেশের মাটি দিয়ে গড়া নয়, স্বদেশ বলতে তিনি তাঁর দেশের দুঃখ-দুর্দশায় নিপীড়িত, নিষ্পেষিত জনসাধারণকেই বুঝতেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্বদেশের মুক্তির একমাত্র অর্থ ছিল তাঁদের মুক্তি। সেই জন্যই যেখানেই অত্যাচার, যেখানেই দুঃখ-লাঞ্ছনা, তার প্রতিকারের জন্য তিনি তাঁর সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তখন বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের সবেমাত্র সূচনা। কারখানায় কারখানায় শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও লাঞ্ছনা চলত। দেশের নেতারা এমন কি স্বদেশী নেতাদের মধ্যেও খুব কম লোকই এই হতভাগ্য শ্রমিকদের জন্য সত্যিকারের দরদ নিয়ে চিন্তা করতেন। কিন্তু লিয়াকত হোসেন মূলতঃ রাজনৈতিক কর্মী হলেও শ্রমিকদের মধ্যেও তাঁর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত ছিল। সে সময়কার শ্রমিক আন্দোলনে বিশেষ করে রেলওয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সুপরিচিত নেতা। তাঁর বক্তৃতা অতি সহজেই শ্রমিকদের হৃদয়কে স্পর্শ করত। তিনি আসানসোল ও বাড়িয়ায় রেলওয়ের ধর্মঘটী শ্রমিকদের বহুসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং আসানসোলের রেলওয়ের ধর্মঘটী শ্রমিকদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তুলেছিলেন। বর্তমানে যাঁরা শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আছেন, অন্যতম পথ প্রদর্শক হিসাবে মৌলবী লিয়াকত হোসেনের নাম তাদের অবশ্যই স্মরণ রাখা উচিত।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য সরকারের অদৃশ্য হস্তের ইঙ্গিতে এবং ঢাকার নবাব আরও কয়েকজন সাম্প্রদায়িক মুসলমান নেতার চক্রান্তের ফলে ১৯০৬-০৭ সালে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি কয়েকটি জেলায় পরপর কতগুলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। স্বদেশী আন্দোলনের ওপর এ এক পাষণ্ড আঘাত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সরকার এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আন্দোলনকারীদের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। এই দাঙ্গার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লিয়াকত হোসেন নিজের উদ্যোগেই ময়মনসিংহ ছুটে গিয়েছিলেন। প্রথম অবস্থাতেই এই দাঙ্গাকে রুখবার জন্য তিনি তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। এই উপলক্ষে পুলিশ তাঁর হাতে লেখা একটি পুস্তিকার পাণ্ডুলিপি হস্তগত করেছিল। সেই পুস্তিকায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গ-হাঙ্গামার পিছনে যে সমস্ত চক্রান্তকারী মুসলমানের দুষ্ট হস্ত কাজ করে চলেছিল, তিনি তাদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন।
মৌলবী লিয়াকত হোসেনের রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায় সম্পর্কে যেটুকু খবর পাওয়া গেছে, এবার তার উল্লেখ করছি। ১৯০৭ সালে ৩রা জুন তারিখে তার লিখিত একটি উর্দু পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মনে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। লিয়াকত হোসেন ও তাঁর সহকর্মী আবদুল গফুর এই পুস্তিকাটি বিতরণের জন্য বরিশাল গিয়েছিলেন। এই খবর পাবার সাথে সাথেই তাঁদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই রাজদ্রোহাত্মক মামলার বিচারে লিয়াকত হোসেনকে দীর্ঘ তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
দেশপ্রেমিক লিয়াকত হোসেনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা কোনো কিছুই জানিনা। তাঁর এই কর্মময় মহৎ জীবনের পরিণতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। এটা খুবই দুঃখের কথা, লজ্জার কথাও বটে। তবুও আশাকরি, তাঁর এই জীবনাদর্শ প্রদীপ্ত মশালের মতো তাঁর উত্তর-সাধকদের পথ দেখিয়ে চলবে।
আবদুর রসুল
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা আবদুর রসুল সে যুগের বাংলার একটি বিশেষ স্মরণীয় নাম। তিনি ১৮৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মভুমি বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments