শেখ উল হিন্দ মাহমুদ আল হাসান

এটা খুবই আশ্চর্যের কথা, মাহমুদ আল হাসান নামটি আমাদের দেশের খুব কম লোকের কাছেই পরিচিত, দেশকে যারা ভালবাসেন, এই নামটি তাদের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেওবন্দ শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষালাভ করে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই পতাকাবাহীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর প্রভাবে ও দৃষ্টান্তে এই শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষাকর্মীরা সংগ্রামী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

মাহমুদ আল হাসান ১৮৫১ সালে উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি তাঁর পিতার সাথে মিরাটে ছিলেন। এই মিরাটেই সিপাহীদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। ছয় বছর বয়সের বালক মাহমুদ আল হাসান তখন থেকেই এই বিদ্রোহীদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী এবং বিদ্রোহ ভেঙ্গে পড়ার পর ব্রিটিশ সরকারের নৃশংস অত্যাচারের কথা শুনে এসেছে। এই সমস্ত ঘটনা সেই সময় থেকেই তার মনের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি সে সব কথা কোনোদিনই ভুলে যেতে পারেন নি এবং তাদের মধ্যে দিয়েই তিনি তাঁর ভবিষ্যতের চলার পথের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। এ এক বিচিত্র কথা, এই সিপাহী বিদ্রোহের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার তীব্র প্রতিক্রিয়া আলীগড় শিক্ষা-কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোর বিরোধীতে পরিণত করেছিল। আবার সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মাহমুদ আল হাসান স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানবাণী শুনতে পেয়েছিলেন। সারা ভারতের মুসলমান সমাজের সামনে আলীগড় শিক্ষা কেন্দ্র ও দেওবন্দ শিক্ষা-কেন্দ্র সম্পূর্ণ দুটি বিপরীত আদর্শ রেখে এগিয়ে চলেছিল। প্রথমটি ব্রিটিশের অনুগ্রহ ও করুণার উপর নির্ভর করে চলাকেই উন্নতির একমাত্র চলার পথ হিসাবে গ্রহণ করেছিল, অপরটি চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে।

পনের বছর বয়সের এই কিশোর দেওবন্দে শিক্ষালাভ করতে এলেন। এখানে তিনি মহম্মদ কাশেম নানাউতোভী ও রশিদ আহমদ গানগোহীর মত বিখ্যাত আলেমদের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাঁদের কাছ থেকে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয় দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রেরণা লাভ করেছিলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ সংগ্রামী জীবনের পক্ষে এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মাহমুদ আল হাসান এখানকার শিক্ষা শেষ করে ১৮৭৫-৭৬ সালে এই শিক্ষাকেন্দ্রই শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অবশেষে ১৮৮৭-৮৮ সালে তিনি এখানকার অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হলেন। কৈশোরের দিনগুলি থেকেই তিনি স্বদেশের মুক্তি সাধনকে তাঁর জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সেই থেকেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি কোনোদিন সে আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হননি। এতদিন ধরে যে সংকল্প তিনি মনে মনে পোষণ করে এসেছেন ১৯০৫ সালে তিনি তাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করলেন। সারা জীবন ধরে স্বদেশে ও স্বদেশের বাইরে তিনি এই সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে চলেছিলেন।

দেওবন্দ-এ মূল শিক্ষাকেন্দ্রের বাইরে দিল্লী, দীনাপুর, আমরোট, করাঞ্জীখেদা এবং চকওয়ালে-এর শাখা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। ভারতের বাইরেও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ‘ইয়াগিস্তান’ নামক ছোট একটি রাজ্যেও একটি কর্মকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। রায় বেরিলির সৈয়দ আহমদের অনুবর্তীরাও এই পার্বত্য অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করেছিলেন। তাদের ভষ্মাবশেষ দুটি একটি ষ্ফুলিঙ্গ তখন ইয়াগিস্তানে ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। মাহমুদ আল হাসান ও তাঁর অনুবর্তীরা এই ইয়াগিস্তানেই তাদের গোপন কেন্দ্র স্থাপন করলেন।

প্রথম হিজরত সংগ্রামের সময় রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদের অনুবর্তী মৌলবী বেলায়েত আলী ও শওকত আলী এই পার্বত্য অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই ইয়াগিস্তানে বসেই মাহমুদ আল হাসান স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার সংকল্প করলেন। এই অঞ্চলের অধিবাসী হাজী তুরঙ্গজাইকে এই বাহিনীর সেনাপতির পদে নিয্ক্তু করা হলো। আশা করা গিয়েছিল প্রধানত উপজাতীয় অঞ্চলের লোকদের নিয়ে এই সৈন্যবাহিনী গঠন করা হবে এবং ভারত থেকে মুজাহীদরা এসে এদের শক্তিবৃদ্ধি করবে। তারা এটাও আশা করেছিলেন যে এই স্বাধীনতার যুদ্ধে আফগাস্তিানের আমীরও তাদের সাহায্য করবেন।

একটা জিনিস মনে রাখা দরকার। কেবলমাত্র মুসলমানদের দিয়ে এই সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে, এই পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ভারত হিন্দু, মুসলমান, শিখ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বাসভূমি, কাজেই তারা আশা করেছিলেন যে অদূর ভবিষ্যতে সকল সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পাঞ্জাব থেকে ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধী এবং বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন বিপ্লবী নেতাকে মিলিতভাবে পরামর্শ করার জন্য দেওবন্দে নিয়ে আসা হয়েছিল। ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধী ছিলেন ধর্মান্তরিত শিখ, কাজেই শিখদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার পক্ষে তার সুযোগ-সুবিধা ছিল। সশস্ত্রবাহিনী গঠনের জন্য যুদ্ধ-নিপুণ শিখদের যোগদান একান্ত প্রয়োজনীয়। মাহমুদ আল হাসানের মনে প্রথম থেকেই এই চিন্তাটা ছিল। পাঞ্জাব ও বাংলাদেশ থেকে পরামর্শ করার জন্য যাদের আনানো হলো, তাদের গোপনে অবস্থান করার জন্য দেওয়বন্দে একটি বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধী মাহমুদ আল হাসানের প্রাক্তন ছাত্র। দেওবন্দের শিক্ষা-কেন্দ্রেই তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন। গুরুর কাছ থেকে ডাক পেয়ে তিনি পাঞ্জাব থেকে চলে এলেন দেওবন্দে। ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধী এখানে এসেই প্রথমে জমিয়ত-উল-আনসারী, অর্থাৎ যারা এই সংগ্রামে সহযোগীতা করবেন তাদের নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে হাত দিলেন। এরপর মাহমুদ আল হাসান তাকে দিল্লীতে পাঠালেন। তিনি সেখানে গিয়ে ‘নজরত-উল-শরীফ’ নামে ধর্মীয় শিক্ষায়তন স্থাপন করলেন। হাকীম আজমল খান এবং আলীগড়ের ভিকার-উল-মূলক এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর থেকে ওবায়েদুল্লাহ্ সিন্ধীর সংগঠনশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন তার গুরু মাহমুদ আল হাসানের দক্ষিণ হস্তস্বরূপ।

১৯১১ সাল। এই সময়টি ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যন্ত মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলাটা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে আসছিল, ব্রিটিশ সরকারও এখানকার মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ভাব অবলম্বন করে চলেছিল। কিন্তু এবার নানাকারণে সেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেলো। ইতিপূর্বে মুসলমানদের হতাশ করে বঙ্গভঙ্গের বিধানকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কথা রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করা হলো। সবচেয়ে বড় কথা এই সময় ইংল্যাণ্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি খ্রীস্টান শক্তি একত্র হয়ে তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বলকান যুদ্ধ শুরু করেছিল। এর ফলে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভের ভাব মাথা জাগিয়ে উঠেছিল। তাছাড়া এর কয়েক বছর বাদেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে যোগ দিল।

এই সমস্ত অনুকূল লক্ষণ দেখে মাহমুদ আল হাসান উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে হলো এইবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করার সময় এসে গেছে। তারা এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে একটি রেশমী কাপড়ের উপরে তা লিপিবদ্ধ করলেন। যারা এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের প্রত্যেকের কাছে এর একটি করে নকল পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই স্বাধীনতার সংগ্রামে সাহায্য লাভের আশায় ওবায়েদুল্লাহ্ সিন্ধীকে আফগানিস্তানে পাঠানো হলো।

ওবায়েদুল্লাহ্ অনেক আশা নিয়ে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থকাম হতে হলো। আফগানিস্তনের আমীর হাবীবউল্লাহ্ প্রথমে তাঁকে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে অবস্থাটা সুবিধার নয় বুঝে সাহায্য তো করলেনই না, বরং তাদের এই গোপন পরিকল্পনার কথা ভারত সরকারের কাছে ফাঁস করে দিলেন।

যে সমস্ত ভারতীয় বিপ্লবী বিদেশে অবস্থান করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চলেছিলেন তাঁদের মনেও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এ বিষয়ে আফগানিস্তান সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্যে পাওয়া যাবে। ইতিপূর্বে এই উদ্দেশ্যে জার্মানী থেকে একটি ‘ইন্দো জার্মান মিশন, আফগানিস্তানে এসে গিয়েছিল। এখানকার পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পেরে এই মিশনের মধ্যে যে কজন জার্মান সভ্য ছিল তারা জার্মানীতে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও বরকতউল্লাহ্ মিশনের এই দুজন ভারতীয় সদস্য তখনও সেখানে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice