হোসেন আহমদ মাদানি

হোসেন আহমদ মাদানি তাঁর কৈশোরে দেওবন্দ শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থী হিসাবে এসেছিলেন, তিনি মাহমুদ আল হাসানের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এখানকার শিক্ষা শেষ হওয়ার আগে তাঁর পিতা ১৮৮৯-১৮৯০ সালে তাঁকে নিয়ে মক্কায় চলে যান। তাঁরা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। তখন থেকে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত হোসেন আহমদ প্রধানতঃ হেজাজে অবস্থান করতেন, তবে মাঝে মাঝে ভারতে আসতেন। মাহমুদ আল হাসান যখন ভারত থেকে মক্কা এলেন তখন পর্যন্ত হোসেন আহমদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সর্ম্পক ছিলনা। কিন্তু মাহমুদ আল হাসানের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ফলে তিনি ভারতের সংগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। মাহমুদ আল হাসানের প্রিয় শিষ্য এবার তাঁর সহকর্মী ও পরামর্শদাতা হয়ে দাঁড়ালেন।

মাহমুদ আল হাসান মক্কায় অবস্থান করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর শিষ্য ও দক্ষিণ হস্ত-স্বরূপ মাদানি সে সময় ভারত ত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সেই উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন। তাঁদের কার্যকলাপের দিকে ব্রিটিশ গোয়েন্দার প্রখর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ ভাগে ব্রিটিশের উস্কানিতে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে মক্কায় এক বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহীরা মাহমুদ আল হাসান, হোসেন আহমদ মাদানি এবং তাদের দুজন সঙ্গীকে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার এদের সবাইকে মারাঠা দ্বীপে আটক করে রাখবার ব্যবস্থা করলেন, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সেখানেই আটক থাকতে হয়েছিল।

অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর ব্রিটিশ সরকার মাহমুদ আল হাসান ও হোসেন আহমদ মাদানিকে মুক্তি দিয়ে তাদের বোম্বাইতে পাঠিয়ে দিলেন। এটা ১৯২০ সালের কথা, তখন ভারতে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। হোসেন আহমদ মাদানি তার গুরুর সাথে সাথেই খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন। এই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অসহযোগ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা মৌলানা আজাদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। এখানে এসে তিনি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী আরবী মাদ্রাসার পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। তিনি কলকাতা থেকে সিলেটে চলে যান। সেখানে তিনি হাদিসের অধ্যাপনা কার্যে ৬ বৎসরকাল কাটিয়েছিলেন।

হোসেন আহমদ মাদানি ১৯২৮ সালে দেওবন্দ শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যে নিযুক্ত হলেন। তাঁর জীবনের পরবর্তী ৩০ বৎসর তিনি সেখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে শুধু অধ্যাপনা করেই দিন কাটেনি, সেই সময় থেকে তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ গ্রহণ করা এবং আইন অমান্য করার জন্য তাঁকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বিশিষ্ট যোদ্ধা হিসেবে এইভাবে বারে বারেই তাঁকে সরকারী নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের নেতারা এবং যে সমস্ত উলেমা স্বাধীনতা আন্দোলনের সংস্রব ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু যত বাধাই আসুক না কেনো, এবং তাঁর বিরুদ্ধে যত কটুক্তিই বর্ষিত হোক না কেনো তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রামের পথ থেকে তিলমাত্র ভ্রষ্ট হন নি, মুসলিম লীগের বিদ্বেষমূলক প্রচারের ফলে সারা দেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আহমদ হোসেন মাদানি চিরদিন হিন্দু-মুসলমানের মিলনের দৃঢ়মূল আদর্শকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এ কথা সত্য তাঁর গুরু মাহমুদ আল-হাসানের কাছ থেকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু মাহমুদ আল হাসানের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পার্থক্যও ছিল। কেবলমাত্র ভাবাবেগ দ্বারাই তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও কার্যকলাপ পরিচালিত হতো না, সমাজে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাগুলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন।

ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর যে সমস্ত রচনা আছে, তা থেকে এর যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

ধর্মীয় ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত গভীর ও উদার। ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে পাশ্চাত্য শক্তিগুলির

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তাঁর মতো একান্ত ধর্মপ্রাণ একজন মৌলভীর পক্ষে এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল সেকথা ভাবতে গেলে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। তবে এটা আমরা অনুমান করতে পারি, বিশ্বের মুসলমানদের মিলনস্থল মক্কায় ১০ বছর ধরে অবস্থান করার ফলে এবং মলিচায় ৫ বছর অবরুদ্ধ জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে তিনি বিভিন্ন মুসলমান দেশের রাজনৈতিক মহলের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করেছিলেন। শুধু তাই নয় মুসলমান ছাড়াও জার্মানী, অস্ট্রিয়া, ইতালি প্রভৃতি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের রাজনীতিকদের সাথে তার পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটেছিল। সম্ভবতঃ তাদের সংস্পর্শে আসার ফলেই তিনি আন্তর্জাতিক অবস্থা সম্পর্কে এতটা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

মাহমুদ আল হাসানের চিন্তাধারার পরিচয় তার গোটাকয়েক বক্তৃতা এবং অনুবর্তীদের লেখার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু হোসেন আহমদ এমন প্রচুর সংখ্যক রচনা রেখে গেছেন যার মধ্য দিয়ে তাঁর চিন্তাধারা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

ধর্মীয় শাস্ত্রবেত্তা হিসেবে তিনি কোরান ও হাদিসকে মানুষের জীবনের পদপ্রদর্শক বলে মনে করতেন। কিন্তু ধর্মকে অত্যন্ত ব্যাপক ও উদার দৃষ্টি নিয়ে দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধর্মের ক্ষেত্র কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস, আরাধনা, অনুষ্ঠান এবং নীতির প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির উপরেও তার অধিকার প্রসারিত। অসীম ও সসীম বৈষয়িক জগতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলেই একজন গভীর ধর্মপ্রাণ লোক হওয়া সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে কখনই বাঁধেনি।

তাঁর মতে যারা চিন্তা বাক্য ও কার্যের মধ্য দিয়ে খোদার ইচ্ছাকে মান্য করে চলে এবং যে কোনো মহল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নির্দেশ দিলে তা পালন করে চলতে অস্বীকার করে চলে তারাই হচ্ছে সত্যিকারের মুসলমান। এই নীতি অনুসরণ করে চললে অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে হয়, কোন সত্যিকারের মুসলমান তাঁর স্বাধীনতাকে কোন পার্থিব শাসকের কাছে বাঁধা রাখতে পারে না। বিশেষ করে যে মুসলমান বিদ্বেষী শাসক ইসলামের আদর্শ ও জীবন ধারাকেই ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তার আইন ও সরকারী বিধান রচনা করে থাকে কোনো মুসলমানের পক্ষেই কোনো অবস্থাতেই তার অধীনতা স্বীকার করে থাকা চলে না।

কাজেই ভারতের উপর ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করাই হচ্ছে এখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য। তার রচনাবলীর মধ্য থেকে এমন বহু দৃষ্টান্ত দেখানো যায় যেখানে তিনি মুসলমানদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার জন্য এবং ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিদেশী শাসকের অবসান ঘটানোর জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

এই বিদ্রোহ যে সম্পূর্ণভাবে ন্যায়সঙ্গত তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলেছেন। তার আত্মজীবনী দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম খণ্ডে ৩৩৬ পৃষ্ঠার মধ্যে ২০০ পৃষ্ঠায় তিনি ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতের যে ধ্বংসাত্মক ফলাফল ঘটেছে সেই চিত্রটি তুলে ধরেছেন। সেই ফলাফলগুলি হচ্ছে ১. বর্ণগত ও জাতিগত বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে এবং দেশীয় লোকদের উচ্চ সরকারী পদলাভ থেকে বঞ্চিত করে তাদের অবমাননা ও লাঞ্ছনা। ২. ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত প্রশাসন ব্যবস্থা এবং দেশীয় লোকদের ব্যবসা-বানিজ্য মারাত্মক ক্ষতি সাধনের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার শোচনীয় পরিনতি। ৩. বিচার কার্য পরিচালনার ব্যাপারে যে ভ্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে মামলা মোকদ্দমা ও দুর্নীতির হার বেড়ে গিয়েছে এবং মামলা পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামলা শেষ করতেও বহু সময় লেগে যাচ্ছে। ৪. আইন প্রণয়নের কাজকে ভারতীয়দের অধিকার বহির্ভূত করে রাখা হয়েছে। ৫. বৈদেশিক শক্তির অধিক ক্ষমতা হয়ে থাকার ফলে জনসাধারণের নৈতিক অবনতি ঘটেছে।

পাশ্চাত্য শক্তিগুলি কিভাবে মুসলমান রাজ্যগুলি বিশেষ করে তুর্কী সাম্রাজ্যের সঙ্গে বার

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice