ঢাকা জেলার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের একটি রক্তরাঙ্গা অধ্যায়

১৯৪৬ সাল। ঢাকা জেলার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বৎসর। আজ থেকে বাইশ বছর আগে এখানকার ৯,০০০ সুতাকল শ্রমিক দীর্ঘ তিন মাসব্যাপী ধর্মঘট সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে সারা বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক রক্তরাঙ্গা অধ্যায় যোজনা করে দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক তথা মেহনতী জনতার এ এক গৌরবময় উত্তরাধিকার। আজ আমাদের এখানকার শ্রমিক ভাইরা আর যারা শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের মধ্যে এমন ক’জন আছেন যাঁরা সেই সময়কার সেই সমস্ত রোমাঞ্চকর ঘটনার সঙ্গে পরিচিত? বিশেষ করে তাঁদের মনে করেই এই কাহিনী লিখতে বসেছি।

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার ওপারে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিল, এপারে ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল আর ঢাকা শহরে বুড়ীগঙ্গার তীরে ঢাকা কটন মিল-এই পাঁচটি কাপড়ের কল নিয়ে পূর্ববঙ্গের শিল্পায়নের সূচনা হয়েছিল। এই পাঁচটি মিলে আনুমানিক ৯.০০০ শ্রমিক কাজ করত। যে সময়ের কথা বলছি, তখন এদের সব কয়টিতেই শক্তিশালী ইউনিয়ন ছিল। শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৮০ জন ইউনিয়নের সভ্য ছিল। অবশিষ্ট যারা তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ইউনিয়নের সমর্থক। “ঘরের শত্রু বিভীষণ” মিল কর্তৃপক্ষের দালালরা কি ছিল না? হ্যাঁ, তাও ছিল। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিল যৎসামান্য। সেদিন ইউনিয়ন সচেতনতা ও সংগ্রামী মনোভাবের দিক দিয়ে এখানকার সুতাকল শ্রমিকদের তদানীন্তন সারা বাংলার শ্রমিক সমাজের সামনে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরা হতো।

১৯৪৬ সালে মিল কর্তৃপক্ষ আর শ্রমিকদের মধ্যে যেই বিরোধটা বাঁধল, তার সূচনা হয়েছিল চালের দর নিয়েই। স্মরণ রাখতে হবে, ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের তিন বছর পরের কথা বলছি। কাগজপত্রে দুর্ভিক্ষ তখন শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা ছিল কি? দুর্ভিক্ষের তাণ্ডবে সারা সমাজে ভেঙ্গেচুরে তচনচ হয়ে গিয়েছে। যারা সেই দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের অনেকেই কোনোমতে টিকে আছে মাত্র, সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নাই। চালের দর আগেকার তুলনায় কমেছে বটে, কিন্তু তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বহু ঊর্ধে। সেই সময়ে সরকার ও মিল কর্তৃক্ষের তরফ থেকে শ্রমিক অঞ্চলে রেশনিং প্রথা প্রবর্তনের প্রস্তাব এল। তখন রেশনে চালের দর ১৪ টাকা।

শ্রমিকরা কিন্তু এই ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিল না। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের প্রথম দিকে বহু আন্দোলনের ফলে তারা মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই স্থায়ী বন্দোবস্তে এসেছিল যে, শ্রমিকদের মাথাপিছু ১০ টাকা দরে ১ মণ করে চাল দেওয়া হবে। সেই থেকে এই পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই চালু হয়ে আসছিলো। এই ব্যবস্থার ফলে সেই দুর্দিনে গ্রামঞ্চলের অন্যান্য লোকদের চেয়ে মিলের শ্রমিকদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। মিলের নিজস্ব স্বার্থের দিক থেকেও এই ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। কেননা, সেই কঠিন আকালের সামনে শ্রমিকদের অসহায়ভাবে ছেড়ে দিলে মিলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতো। এমন কি মিলগুলি অচল হয়েও যেতে পারত।

সমস্যাটা নিয়ে শ্রমিক নেতারা একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। কেননা, এর ভালোমন্দ দু’টো দিকই আছে। রেশনের চাল নিতে গেলে দাম একটু বেশী পড়বে বটে কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে চাল কিছুটা বেশী পাওয়া যাবে। অপর পক্ষে শ্রমিকরা বলছিলেন, রেশনের দরের স্থিরতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা কি? যে কোনো সময় দর বাড়িয়ে দিতে পারে। পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে এই সন্দেহটা তাদের মনে জেগেছিল এবং পরবর্র্তীকালে তাদের এই আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের এই রায়কে মাথা পেতে মেনে নিলেন। তদানুসারে পূর্বতন ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবী নিয়ে আন্দোলন চলতে লাগল।

ঠিক এমনি সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যা শ্রমিক-মালিক বিরোধকে এক নূতন পর্যায়ে নিয়ে গেল। কোনো পক্ষই এর জন্য আগে থেকে তৈরী ছিল না। বোম্বাই থেকে কমরেড পি, সি, যোশী এলেন ঢাকায়। তিনি তখন সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে একজন। দীর্ঘদিন থেকেই সারা ভারতের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি অতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁকে দেখবার জন্য এবং তার চেয়েও বড় কথা, তাঁর মুখের কথা শুনবার জন্য এখানকার শ্রমিকরা চঞ্চল হয়ে উঠল। অপর পক্ষে এখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে মিলবার জন্য কমরেড যোশীর আগ্রহও তাদের চেয়ে কম ছিল না। সে সময় ঢাকা সুতাকল শ্রমিকদের কৃতিত্বপূর্ণ আন্দোলন ও সংগঠনের কথা প্রদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া কমরেড যোশী প্রথম থেকেই এখানকার শ্রমিকদের আন্দোলন সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল ছিলেন। তাই তিনি তাদের স্বচক্ষে দেখবার জন্য এবং তাদের সাথে মিলবার জন্য উদগ্রীব হবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। স্থির হলো নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক সমাবেশ হবে এবং কমরেড যোশী তাদের সামনে বক্তৃতা দেবেন।

কাছাকাছি কোনো রবিবার ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে কাজের দিনে সভার তারিখ ধার্য করতে হলো। শ্রমিকদের তরফ থেকে স্থির করা হয়েছিল যে, এই কাজের দিনটা কামাই করে কমরেড যোশীর বক্তৃতা শুনতে যাবেন এবং পরবর্তী রবিবার দিন কাজ করে ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। এটা নতুন কিছু নয়। আগে থেকেই এই রেওয়াজটা চলে আসছিল। এর আগেও মন্ত্রীরা বা বিশিষ্ট জননেতারা শ্রমিকদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। কাজের দিন হলে শ্রমিকরা রবিবার কাজ করে তার ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছে। এবারও তাই হবে, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নামতে গিয়ে দেখা গেল ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। শ্রমিক প্রতিনিধিরা বিষয়টা নিয়ে মিল কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা এক কথায় জবাব দিয়ে দিলেন, না, হবে না। কেনো হবে না, শ্রমিক প্রতিনিধিরা তার কারণ জানতে চাইলেন। এতোদিন ধরে যে রেওয়াজটা চলছিল, তার কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ তাঁদের যুক্তিতে কর্ণপাত করলেন না। কেনো হবে না সে সম্পর্কে তারা কোনো যুক্তি দেখালেন না, শুধু স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিলেন এ হবে না হতে পারে না।

মালিকপক্ষ এমন উগ্রভাবে শ্রেণী সচেতন যে, তাঁরা কমরেড যোশীর মতো গরীব দলের নেতাকে শ্রমিকদের সঙ্গে মিলতে দিতে রাজী নন এবং তাকে নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও রাজী নন।

এর ফলে শ্রমিকদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। নির্দিষ্ট তারিখে সব কয়টি কাপড় কলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে কমরেড যোশীর সভায় যোগ দিয়েছিল। তাই ঘটনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একজন নেতার বক্তৃতা শুনবার জন্য পাঁচটি মিলের শ্রমিকদের ধর্মঘট করতে হয়েছে, শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল।

পাঁচটি মিলের শ্রমিকদের মতোই পাঁচটি মিলের মালিকপক্ষও যুক্তভাবে কাজ করে চলেছিলেন। তাঁরা যা কিছু করবার সবাই মিলে বুদ্ধি পরামর্শ করেই করতেন। শ্রমিকদের এই ধর্মঘটকে তাঁরা কিছুতেই নিঃশব্দে হজম করে নিতে পারলেন না। শ্রমিকদের আন্দোলনের মূলকে ছিন্ন করে দেবার জন্য তাঁরা ধর্মঘট করার অভিযোগে পাঁচটি মিলের বাছা বাছা একুশ জন নেতৃস্থানীয় কর্মীকে ছাটাই করে দিলেন। এই ২১ জনের মধ্যে যে ৯ জনের নাম মনে পড়ছে তারা হচ্ছেনÑ ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের সতীশ ভদ্র, ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের উপেন্দ্র দাস, নরেশ রায়, আবদুল মান্নান চৌধুরী, মৈনুদ্দীন ঢালী, চিত্তরঞ্জন কটন মিলের সুনীল রায়, রমণী গোসাই, আফসার মিয়া, ও নারায়ণ ভট্টাচার্য।

ছাঁটাই হচ্ছে মালিকপক্ষের হাতের মোক্ষম হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়েই তাঁরা শ্রমিক আন্দোলনকে ছিন্নমূল করে দিতে চেষ্টা করেন। এই ২১ জন বাছা বাছা নেতৃস্থানীয় কর্মীকে ছাঁটাই করে দিয়ে তাঁরা হয়তো মনে মনে ভাবছিলেন আপাতত কিছুকাল একটু আরামে দম ফেলবার সময় পাওয়া যাবে! অবশ্য শ্রমিকরা এই আঘাতের পর একদম ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, এমন কথা তাঁরা মনে করেন নি। তার কারণ, দীর্ঘদিনের হানাহানির মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice