পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের আদিপর্ব

দু’বছর সাজা খেটে জেল থেকে বেরিয়ে এলো হোসেন। তখন ১৯৫১ সালের শেষ ভাগ। হোসেন অনেক দিন আগে থেকেই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এবার তাকে জেল খাটতে হয়েছে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে। সেই ইতিহাসটা প্রথমে বলে নেওয়া দরকার। ১৯৪৯ সাল। তখন ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকার দোর্দণ্ড প্রতাপে তার স্বেচ্ছাচারী শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিচারে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলা বা কোনো কিছু করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামান্তর। সরকারের অনাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যাঁরাই প্রতিবাদ করতে গেছেন অথবা সরকার যে কোনো কারণেই হোক, যাদের কার্যকলাপ আপত্তিকর বলে বিবেচনা করেছেন, তাদের সবাইকে বিনা বিচারে জেলখানায় আটক করা হয়েছে। আবার বহু রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক কর্মী ও কৃষক কর্মীকে বিচারের প্রহসন স্বরূপ মাসের পর মাস ধরে হাজতবাস করানো হচ্ছে।

সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে প্রায় সবাই জেলে। শুধু দু’চারজন গা ঢাকা দিয়ে গোপনে গোপনে কাজ করে চলেছেন। মহিলারা জেলখানায় অনশনরত বন্দীদের দাবী সমর্থন করে বুড়ীগঙ্গার পাড়ে করোনেশন পার্কে সভা করতে গিয়েছিলেন। সভা করার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তা সত্ত্বেও তাদের সভা মারপিট করে ভেঙ্গে দেওয়া হলো। সভার মধ্য থেকে আট দশজন মহিলাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নিরাপত্তা আইনে বিচার করে ঢাকা জেলে আটক করা হলো। এই ভাবে তারা প্রদেশ জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছিল।

এদিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভিতরে আটক রাজবন্দীরা তাঁদের রাজনৈতিক মর্যাদা ও দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য মাসের পর মাস ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিপূর্বে পর পর তিনবার অনশন ধর্মঘট হয়ে গেছে। প্রথমবার ৫ দিন, দ্বিতীয়বার ২৪ দিন, তৃতীয়বার ৪০ দিন। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দীদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জেল-কর্তৃপক্ষ আর রাজবন্দী-‘দু পক্ষে ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। পরিস্থিতি ক্রমশঃই গুরুতর হয়ে উঠছিল।

এবার জেনানা ফাটকের নবাগত রাজবন্দিনীরা তাদের সেই সংগ্রামে শামিল হলেন। শত্রু-শিবিরের মাঝখানে বসেও তাঁরা সেদিন অদ্ভুত শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। জেল-কর্তৃপক্ষ তাদের ভয় দেখিয়ে পোষ মানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। নিজেদের মর্যাদা ও দাবী আদায় করতে তাঁরা মরিয়া হয়ে নেমেছিলেন। জীবনের মায়া বলতে কোনো কিছুই যেন তাদের ছিল না। কুড়ি বছর আগেকার ঘটনাবলী। তাদের অনেক কথাই ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু আজও যখন জ্বলন্ত মশালের মতোই প্রদীপ্ত আমাদের সেই সংগ্রামী বোনদের কথা স্মরণ করি, তখন অবসন্ন মুহূর্তেও অনুপ্রাণিত হয়ে উঠি।

জেনানা-ফাটক গোলমাল ও অশান্তির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন কি একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করে ওরা সেই সমস্ত রাজবন্দীদের উপর মারপিট করল। সঙ্গে সঙ্গে সেই সংবাদ বিদ্যুৎবেগে সারা জেলখানায় ছড়িয়ে পড়ল। তার পর শতাধিক কণ্ঠে শ্লোগানের পর শ্লোগান-জেলখানার দেয়ালগুলি থর থর করে কেঁপে উঠল। অপর দিকে জেলখানার পাগলী ঘণ্টি বেজে চলেছে। তার পর-তার পর চলল লাঠিচার্জ। বন্দীদের মধ্যে অনেকেই জখম হয়ে ভূমিশয্যা নিল। ঘটনাটা ঘটেছিল সন্ধ্যার কিছু আগে। এর প্রতিবাদে সেই রাত্রি থেকেই শুরু হয়ে গেল অনশন। চতুর্থ অনশন ধর্মঘট! এই অনশন ৫৮ দিন পর্যন্ত চলেছিল এবং এর মধ্য দিয়েই তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক মর্যাদা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল।

মেয়েদের উপর মারপিটের এই খবর জেলের প্রাচীর পেরিয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই নিয়ে ঘরে ঘরে অসন্তোষের গুঞ্জন চলছিল, কিন্তু এর প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ জানাবার মতো পরিস্থিতি তখনও আসে নি। শুধু জনকয়েক শ্রমিক আর ছাত্র সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন সামনে। এই অনাচার আর অত্যাচারকে তাঁরা নিঃশব্দে হজম করে নিতে পারেন নি। তাঁরা ছোট একটি খণ্ডমিছিল বার করে প্রচার অভিযানে বেরিয়েছিলেন। এই প্রচার অভিযানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে হোসেন ছিলেন অন্যতম।

সেদিনকার পরিস্থিতিতে এ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ, এ কথা তাঁদের অজানা ছিল। প্রচার মিছিল কিছু দূর এগোতেই সরকারের পুলিশ আর তাদের দালালরা এসে হামলা করল তাদের উপর। গ্রেফতার হলেন কয়েকজন। সম্ভবত দাঙ্গা হাঙ্গামার অভিযোগে হোসেন এর দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে গেল।

এই হলো হোসেন ভাইর জেল হবার ইতিহাস। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাঁকে তাঁর নিজের জেলার বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলো। সেই সঙ্গে তাঁকে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে দিল যে, ভালো মানুষের মতো চুপচাপ শান্তিতে না থাকলে ভবিষ্যতে তার অদৃষ্টে এর চেয়েও বেশী দুঃখ আছে। হোসেন ভাইর নিজের সংসারে তখন কেউ কেউ ছিল না। একমাত্র ছেলে, সেও বড় হয়ে উঠছিল তার নানীর কাছে। গ্রামে বসে কি করবেন, হোসনে ভাই তাঁর জীবিকা অন্বেষণে চলে এলেন ঢাকায়।

না, শুধু জীবিকা অন্বেষণে নয়, তার চেয়েও বড় কথা, তিনি তাঁর পুরানো সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসেছিলেন। ফিরে এসে কি দেখলেন? দেখলেন, এই দুই বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। পুরানো সাথীরা কে যে কোথায় ছিটকে ছড়িয়ে গেছে, তার খোঁজ পাওয়া ভার। বহু চেষ্টার পর দু-একজন দায়িত্বশীল কর্মীর খোঁজ পাওয়া গেল। তাঁদের সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করে তিনি কাজের খোঁজে চলে এলেন নারায়ণগঞ্জের মিল অঞ্চলে। হোসেন-ভাই রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ট্রেনিং-পাওয়া ভালো মেকানিক। তাঁর কাজ জুটিয়ে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। হোসেন ভাই আদমজী জুট মিলের মেকানিকের কাজে ঢুকে পড়লেন।

আদমজী জুট মিলের তখন প্রাথমিক অবস্থা। উৎপাদনের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। মাত্র শ’ তিনেক শ্রমিক সেখানে কাজ করছে। তখনও প্রধান কাজ কারখানা তৈরীর কাজ। চার-পাঁচ হাজার শ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত। তারা সবাই অস্থায়ী ভাবে কাজ করে।

এই পাট কল এক বিরাট প্রতিষ্ঠান হতে চলেছে। কিন্তু তার ব্যবস্থা দেখে হোসেন ভাই অবাক হয়ে গেলেন। এই প্রদেশের রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, মিল, কল-কারখানা অনেক কিছুই তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু শ্রমিকদের সম্পর্কে এমন অব্যবস্থা আর কোথাও দেখেননি। দেখা দূরে থাক, এমন যে হতে পারে এ কথা ভাবতেও পারা যায় না। শ্রমিকদের থাকবার জন্য লম্বা লম্বা গোটা পঞ্চাশেক ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। ঘর তো নয়, যেন গরু-ছাগলের খোঁয়াড়। কিন্তু সেই খোঁয়াড়ের মধ্যে যেটুকু আলো-বাতাস আসে এখানে তাও পাওয়া যায় না। এই পঞ্চাশটি খোঁয়াড়ে কাঁচা মাটির মেঝের উপর গাদাগাদি করে হাজার কয়েক শ্রমিক বাস করছে। এরা কি মানুষ না আর কিছু? মিল-কর্তৃপক্ষ সত্য সত্যই এদের মানুষ বলে মনে করে না, গরু-ছাগলের মতোই দেখে।

শুধু ঘরের কথাই নয়, সব দিক দিয়েই দুরবস্থার চরম। হাজার হাজার লোক যেখানে বাস করে, সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নাই। সারা মিল এলাকার মধ্যে সবেমাত্র নীলমণি একটি মাত্র পুকুর। কিন্তু পুুকুর থাকলেই কি? শ্রমিকরা যদি সেই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে যায়, তবে তাই নিয়ে বিষম আপত্তি ওঠে। তবে এরা যাবে কোথায়? একমাত্র সম্বল নদী। কিন্তু সব সময় এতোটা পথ ভেঙ্গে নদী থেকে পানি নিয়ে আসা-সে কি সহজ কথা। আর তাই দিয়ে কি যাবতীয় কাজ চালানো সম্ভব?

অব্যবস্থা সব দিক দিয়েই। এতগুলো লোক এখানে থাকে, অথচ মিল কর্র্তৃপক্ষ এদের ব্যবহারের জন্য পায়খানা তৈরী করবার প্রয়োজনটাও বোধ করে নি। তার ফলে রোজ সকাল বেলা হাজার হাজার লোক যে দৃশ্যের রচনা করে তোলে, তা তাদের নিজেদের পক্ষে লজ্জাকর, সমাজের পক্ষে লজ্জাকর, আর সব চেয়ে বেশী লজ্জাকর তাদের পক্ষে, যারা এই মিল-পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আছেন। কিন্তু মিল কর্র্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বিকার।

হোসেন ভাই এখানে আসার কিছুদিন বাদেই শ্রমিকদের মধ্যে আমাশয় রোগ দেখা দিল। এ রোগ

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice