সুমেরের একটি বিদ্যালয়
প্রায় চার হাজার বছর আগে সুমেরে লিখিত ‘ছাত্র জীবন’ নামে একটি ব্যাঙ্গাত্মক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
‘আমি শিক্ষাফলক (ট্যাবলেট) থেকে আবৃত্তি করলাম। তারপর খেয়ে দেয়ে নূতন মৃৎফলক বানিয়ে নিয়ে তার উপর আমার লেখার কাজ শেষ করলাম। পরে আমাকে আগামী দিনের জন্য মৌখিক পাট বুঝিয়ে দেওয়া হলো এবং বিকাল বেলা পরদিন কি কি লিখে নিয়ে আসতে হবে, তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। বিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেলে পর বাড়ি ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকে দেখি বাবা বসে আছেন। আমি আজ যা যা লিখেছি, বাবার কাছে বললাম এবং ফলক থেকে আবৃত্তি করে শোনালাম। বাবা শুনে মহা খুশী। পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি আমার মার কাছে গিয়ে বললাম, আমি বিদ্যালয় যাচ্ছি, আমাকে আমার খাবার দাও। মা আমাকে দুখানা রুটি দিলেন। তাই নিয়ে আমি বিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হলাম। বিদ্যালয়ে যেতেই ভারপ্রাপ্ত লোকটি আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি আসতে দেরী করেছ কেনো? ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি শিক্ষকের কাছে গিয়ে নমস্কার করে দাঁড়ালাম। শিক্ষক তখন আমার গত দিনের লেখার ফলক সংশোধন করছিলেন। তিনি আমার লেখা দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি, তাই আমাকে কয়েক ঘা বেত খেতে হলো। অতঃপর বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুনের পরিদর্শক, আমি আসার সময় পথের মাঝে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলাম এবং যথোচিত প্রণালীতে কাপড়-চোপড় পড়ে আসিনি। এই দুই অভিযোগে দুই দফা বেত মারলেন।”
এইখানেই শেষ নয়। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে দেখা যাচ্ছে, ক্লাশে কথা বলা, নিজের পালা আসার আগেই উঠে দাঁড়ানো এবং গেটের বাইরে যাওয়া—এই সমস্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে বেত খেতে হয়েছিল। সর্বশেষে প্রধান শিক্ষক তাকে তাঁর কাছে ডাকিয়ে এনে বললেন, ‘তোমার হাতের লেখা সন্তোষজনক নয়, এই বাবদ তিনিও তাকে কিঞ্চিত পিটুনি দিলেন।’ অবস্থা বেগতিক দেখে বিদ্যালয়ের প্রভুদের প্রসন্নতা সাধনের জন্য ছেলেটি তার বাবাকে গিয়ে ধরে পড়ল। ভদ্রলোক ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রধান শিক্ষককে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলেন। তারপর তার ছেলেকে শিক্ষাদানের জন্য তাঁরা যা করে আসছেন, সে জন্য প্রধান শিক্ষকের অজস্র প্রসংসা করলেন। তাকে সমাদর করে খাদ্য ও পানীয় যোগালেন, একটি নতুন পোশাক দিয়ে তাঁকে সুসজ্জিত করলেন। এবং তাঁর হাতের আগুলে একটি আংটি পরিয়ে দিলেন। এ দিকে ছেলেটি পরম বংশবদের মতো তার সেবা করে চলেছে এবং লিখন বিদ্যা সম্পর্কে সে যতকিছু শিখেছে তা তার বাবার কাছে গলগল করে বলে চলেছে। প্রধান শিক্ষক আনন্দে, উৎসাহে বাগবাগ হয়ে উঠলেন। ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে তিনি আশীর্বাদ বর্ষণ করে বললেন: তুমি তোমার ভাইদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ও বন্ধুদের মধ্যে প্রধান হও, বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রদের মধ্যে তুমি সর্বোচ্চ পদ অধিকার করো। তুমি ভালোভাবেই লেখাপড়ার চর্চা করেছ, তুমি বিদ্যার অধিকারী হয়েছ। প্রধান শিক্ষকের নেক নজরে পড়ার ফলে ছাত্র এবার ছাত্র-শিক্ষকদের পদে উন্নীত হয়ে গেলো।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম বিদ্যালয়ের এই ব্যাঙ্গাত্মক প্রবন্ধটি পাওয়া গেছে। এর চেয়েও প্রাচীন বিদ্যালয় যে ছিল না তা নয়, তবে তার সন্ধান এখনও আমরা পাইনি। যতদিন তা না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন এটিকেই প্রাচীনতম বলে গণ্য করতে হবে। খৃষ্টপূর্ব ১৭৮০ বছর অর্থাৎ আজ থেকে ৩৭৪৯ বছর আগেকার কথা। সুমের জাতির অন্যতম বিশিষ্ট নগরী উর-এর (বর্তমানে ইরাকের অংশ) মাটি খনন করার ফলে এই বিদ্যালয়টি আবিষ্কৃত হয়েছে।
তখনও বর্ণমালার আবিষ্কার হয়নি। লিখন বিদ্যাটাকে আয়ত্ত করা খুবই কঠিন ও সময়সাধ্য ব্যাপার ছিল। সেই কারণে মিসর ও সুমের এই দুই জায়গাতেই কঠিন যে সকল লোক লেখকের পেশা গ্রহণ করতে চাইতেন, তাঁদের এই লিখন বিদ্যাটাকে আয়ত্ত করার জন্য খুবই অল্প বয়স থেকেই এই চর্চা শুরু করতে হতো এবং দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষানবিসীর কাজ চালিয়ে যেতে হতো। মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরোহিতদের পক্ষে লিখন বিদ্যাটা একান্ত আবশ্যক ছিল। মন্দিরের কাজের চেয়েও সরকারী কাজের জন্য লেখকদের প্রয়োজন ছিল আরও বেশী। কিন্তু মিসরের বিদ্যাচর্চা পুরোহিত সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ছিল বলেই মনে হয় এবং বিদ্যালয়গুলি সাধারণতঃ মন্দিরের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকত। তবে মিসরের খুব কম সংখ্যক লোকই লেখাপড়া জানত। সম্পন্ন ঘরের ছেলেরাই লেখাপড়া করতে আসত। কেননা গরীব ঘরের ছেলেরা এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী শিক্ষার ব্যয় বহন করতে পারত না।
কিন্তু মিসরের তুলনায় সুমের ও প্রাচীন ব্যাবিলনের জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল অনেকটা বেশী। লেখকদের মধ্যে নানা রকম ভাগ ছিল—নিম্ন পর্যায়ের (High) লেখক ও উচ্চ পর্যায়ের (Junior) লেখক, মন্দিরের লেখক ও রাজ-প্রাসাদের লেখক, যে লেখক সরকারের বিশেষ বিশিষ্ট কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন এবং যে লেখক প্রশাসন কার্যের বিশেষ বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করতেন, তিনিই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও হিসাব রক্ষক। দেশী ও বিদেশী বাণিজ্যের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে হিসাব রক্ষকদের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় ও বৈষয়িক কাজকর্মে হাজার হাজার পেশাদার লেখকের প্রয়োজন হতো। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, এই লেখকদের শিক্ষাদান করবার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হয়েছিল।
এই বিদ্যালয়গুলির মধ্যে কতগুলি মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকত আবার কতকগুলি ব্যক্তি বিশেষের বাড়িতেও চালানো হতো। আমাদের আলোচ্য এই বিদ্যালয়টি এমনি একটি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাড়ির মালিকের নাম ছিল ইগমিল সিন। তিনি ছিলেন একজন পুরোহিত। এই বাড়িটির ৩নং ও ৪নং কক্ষে এবং প্রাঙ্গণে প্রায় দুই হাজার পোড়া মাটির ফলক পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কয়েক শো গোলাকার। এই গোলাকার ফলকগুলিতে ছেলেরা লেখার চর্চা করত; বাকীগুলির মধ্যে অনেকগুলোই ছিল ধর্মীয় পুঁথিপত্র, যেগুলিকে শ্রুতলিপি লেখবার জন্য বা কণ্ঠস্থ করবার জন্য ব্যবহৃত করা হতো। আবার কতগুলো ফলকে অংকের হিসাব, গুণনের নামতা, বর্গমূল, ঘনমূল বার করবার নিয়মাবলী, জমির মাপ ইত্যাদি উৎকীর্ণ আছে। এই সব কিছুর মধ্যে উপরোক্ত প্রবন্ধটিও ছিল। বিদ্যালয়টি ছিল ছোট-চব্বিশ জনের বেশী ছাত্র এখানে ধরত না। ছাত্রেরা প্রাঙ্গনে বা ঘরের মধ্যে বসে থাকত, হাঁটা চলা করত। প্রধান শিক্ষক থাকতেন দোতালায়। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসতেন।
কেবলমাত্র ছেলেরাই এই সব বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিক্ষত। মেয়েদের মধ্যেও লেখক ছিলেন। তাদের কাজের কিছু কিছু নমুনা আমাদের হাতে এসে গেছে। কিন্তু তারা কোথায় এবং কি ভাবে শিক্ষা লাভ করতেন, সে সম্পর্কে কোনো কথাই আমরা জানি না। এ ব্যাপারে মেয়েদের সম্পর্কে কোনোই উল্লেখ্য নাই। ছাত্ররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ শ্রেণী থেকে আসত। খ্রিষ্টপূর্ব দুহাজার সালের পর এমন পাঁচশোর মতো লেখকের নাম পাওয়া গেছে যারা তাঁদের নিজ নিজ পিতার নাম পেশা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন শাসনকর্তা, নগর প্রধান, রাষ্ট্রদূত, মন্দির পরিচালক, সামরিক কর্মচারী, জাহাজের ক্যাপ্টেন, রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী, পুরোহিত, ম্যানেজার, পরিদর্শক, সর্দার, লেখক, সেরেস্তাদার ও হিসাব রক্ষক। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। জনৈক দয়ালু লোক একটি পরিত্যক্ত শিশুকে কুকুরে আক্রমণ থেকে উদ্ধার করে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। এই ছেলেটি বড় হলে পর তিনি তাকে লিখনবিদ্যা শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ছিলেন। অবশ্য এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল। সমাজের নিম্নস্তরের লোকেরা এই বিদ্যাশিক্ষা করবার সুযোগ খুব কমই পেত।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রথমেই প্রধান শিক্ষকের নাম করতে হয়। তিনি ‘বিদ্যালয়ের পিতা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সহকারীদের মধ্যে ছিলেন অংক ও ক্ষেত্রতত্ত্বের (Measuration) লেখক, অংকন বিদ্যার সুমের ভাষা শিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক, বিদ্যালয়ের নিয়ম কানুন পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত লোক, বেত্রদণ্ডের জন্য ভারপ্রাপ্ত লোক ইত্যাদি। ছোট ছোট
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments