প্রাচীন সমাজের আইনকানুন
যেখানে সমাজবদ্ধ জীবন, সেখানে সমাজ পরিচালনার জন্য কতগুলি আইন-কানুন বিধি-বিধান প্রচলিত থাকে। নিয়ম শৃংখলা ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না, নিয়ম-শৃংখলা ছাড়া সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। শুধু কি মানুষ? পশুপাখী থেকে কীট-পতঙ্গ-জীবাণু পর্যন্ত যারা দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করো তাদের সকলের পক্ষেই এ কথা সত্য।
অতীতের প্রাচীন সভ্য জাতিগুলির কোনো কোনোটির মধ্যে প্রচলিত আইনকানুনগুলির লিখিত সংকলন ছিল। কিন্তু সবার মধ্যে ছিল না। থাকলেও তা আমাদের হস্তগত হয়নি। এই সংকলিত আইনকানুনগুলিকে আমরা সংহিতা (Code) নামে অ্যাখ্যা দেব। আমাদের মোহেনজোদারো, হরপ্পা ও প্রাচীন চীনে কি ধরনের আইনকানুন প্রচলিত ছিল, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। মিসর সম্পর্কে পরবর্তী যুগের গ্রীক লেখকরা জানাচ্ছেন যে, সেখানে আইনের সংহিতা সংকলিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের প্যাপিরাসের পাতে লিখিত অজস্র দলিলপত্র পাওয়া গেলেও কোনো সংহিতা বা তার কোনো অংশবিশেষ এখনও পাওয়া যায় নি। প্রাচীন কালের সংহিতার নমুনা আমরা পেয়েছি সুমেরিয়ায়, ব্যাবিলনে, আসিরিয়ায়, প্যালেস্টাইনে এবং হিট্টীয় জাতির রাজধানী হট্টুসাস-এ। এই সংহিতাগুলির মধ্যে ব্যাবিলন-এর সম্রাট হাম্মুরাবির সংহিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে আইন বলতে আমরা যা বুঝি এবং যেই পদ্ধতিতে আইনকানুন রচিত হয়ে থাকে, সেই দৃষ্টি নিয়ে এদের দেখলে ভুল করা হবে। প্রাচীন যুগের এই সংহিতাগুলি প্রায়ই ধর্মীয় নেতা, রাজা বা বিশিষ্ট ব্যক্তির নামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকত, যেমন হাম্মুরাবির সংহিতা, মোশীর (Moses) হিট্টীয় রাজা হট্টু সিলিস বা সুপ্পিলিলিউমার সংহিতা। এই সমস্ত সংহিতাকাররা যে নিজেরাই এই সমস্ত আইন রচনা করতেন তা নয়, তাঁরা সমাজে আবহমান কাল থেকে প্রচলিত বিধিবিধানগুলিকে সংকলন করতেন অথবা আগেকার দিনের সংহিতাকারদের সংহিতার উপর ভিত্তি করে নতুন সংহিতা রচনা করতেন। শুধু তাই নয়, সমাজের পরিবর্তিত অবস্থার কথা বিবেচনা করে তারা প্রয়োজনবোধে পূর্বতন আইনকানুনের সংশোধন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতেন।
ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি জাতের দিক দিয়ে ছিলেন আমোরীয়। ভিন্ন জাতির লোক হলেও আমোরীয় জাতের লোকেরা সুমের জাতীর গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করে নিতে পেরেছিলেন। হাম্মুরাবির রাজত্বকালের বহুকাল আগে নিম্নোক্ত তিনজন সুমের সংহিতাকার তিনটি সংহিতা সংকলন করেছিলেন: (১) ই-সিন রাজ্যের লিবিত ইশতার (২) ই-সিন রাজ্যের ইবি-সিন (৩) উর রাজ্যের উরনম্মু। তাঁদের আগে এমন আরও অনেক সংহিতাকার ছিলেন। তা ছাড়া রাজা হাম্মুরাবির পূর্বপুরুষ ব্যাবিলনের রাজা সুমু-লা-ইলুম-এর সংকলিত সংহিতাও ছিল। সংহিতার সংকলনের ব্যাপারে তাকে প্রধানত এঁদের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছিল।
কিন্তু এর মধ্যে আরও একটা কথা রয়ে গেলো। হাম্মুরাবির সংহিতা সুমেরীয় সংহিতার অনুসরণে রচিত হলেও একটা কথা মনে রাখতে হবে, তাঁরা সুমের জাতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সেমেটিক আমোরীয় জাতির লোক। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদেরও নিজস্ব সামাজিক ঐতিহ্য ও বিধিবিধান ছিল। কাজেই সংহিতা সংকলনের সময় তাঁকে এই দুটো ভিন্ন ধারার মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলার দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়েছে।
এরপরে আসে সমাজের পরিবর্তিত অবস্থার সময়কার কথা। তখন নতুন অবস্থার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রচলিত আইনকানুন সংশোধন ও রূপান্তর সাধন করতে হয় এবং নতুন নতুন আইনেরও প্রবর্তন করতে হয়। হাম্মুরাবির সংহিতায় এরকম দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যাবে। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সুমেরীয় সমাজে দুই শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল—মুক্ত নাগরিক আর ক্রীতদাস। সুমেরীয় আইনে এই দুটি শ্রেণীর অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে বিধান দেওয়া আছে। কিন্তু পরবর্তী কালে নতুন এক শ্রেণীর উদ্ভব হলো। তার নাম মুশকেনু। হাম্মুরাবির সংহিতা এই শ্রেণীকে বাদ দিয়ে চলতে পারল না, এই নতুন শ্রেণীর সম্পর্কেও নতুন করে আইন-কানুন রচনা করতে হলো।
যে বিরাট প্রস্তরখণ্ডে হাম্মুরাবির সংহিতা খোদিত হয়েছিল, তার শীর্ষদেশে রাজা হাম্মুরাবি সূর্যদেব শামাশ-এর সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছেন। এর তাৎপর্য এই নয় যে, রাজা হাম্মুরাবি মোশীর মতো দেবতার কাছ থেকে এই সংহিতা গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে এই কথাটাই প্রকাশিত হচ্ছে যে, রাজা হাম্মুরাবি সূর্যদেব শামস-এর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংহিতা রচনা করছেন। এই অঞ্চলের আইন প্রণয়নের ইতিহাসে সমাজের অবস্থা পরিবর্তনের ধারাটা সুস্পষ্টভাবেই লক্ষ করা যায়।
কিন্তু মিসরীয় ও ইহুদীদের ক্ষেত্রে আইন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী অচল। অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনের সংশোধন বা পরিবর্তনের পরিচয় কমই পাওয়া যায়। মিসরে আখনাটেন এবং তার উত্তরাধিকারীদের কুশাসনের ফলে সারা সমাজে বিশৃংখলা দেখা দিয়েছিল। সেই বিশৃংখলা দূর করে সমাজকে সুস্থ ও সবল করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হোরেমহেব। হোরেমহেব এক জায়গায় উক্তি করেছেন যে, তিনি মিসরের আইনগুলির উন্নতি সাধন করেছিলেন। কিন্তু কার্যত তিনি পুরোনো আইনগুলির কোনো পরিবর্তন সাধন করেননি। সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। তার প্রতিকারের জন্য তিনি কতগুলি নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করেছিলেন, সে কথা সত্য, কিন্তু তার ফলে পুরানো আইনগুলির উপর কোনো আঘাত পড়েনি। দুর্নীতিকে দমন করবার জন্য তিনি এমন এক ব্যবস্থা করেছিলেন যার নজীর আমরা এর আগে আর কোথাও দেখতে পাই না। এই বিশেষ ব্যবস্থাটা হচ্ছে এই যে, তিনি স্থানীয় বিচারপতিদের আয়কর থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, যাতে তাদের মনে উৎকোচ গ্রহণের মতো অবৈধ ভাবে অর্থোপার্জনের দুষ্প্রবৃত্তি না জাগে। আধুনিক কালেও এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
লিখিত সংহিতা না থাকার ফলে মিসরের আইন-কানুনের স্বরূপটা প্রত্যক্ষ ভাবে জানার সুযোগ নাই। সুতরাং ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার সূত্র থেকে তা পরোক্ষভাবে অনুমান করে নিতে হয়। তা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে, মিসরে সমাজের অবস্থার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রয়োজন অনুসারে আইনের পরিবর্তনের সুযোগ ও রেওয়াজ ছিল খুবই কম। এ কথা ইহুদীদের পক্ষে হয়তো আরও বেশী সত্য। মোশী হাম্মুরাবির মতো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজের অবস্থা পুংখানুপুংখরূপে বিবেচনা করে আইন প্রণয়ন করেননি। তিনি সমাজে প্রচলিত কতগুলি বিধিব্যবস্থাকে অপরিবর্তনীয় আইন হিসাবে লিপিবদ্ধ করে রেখে গিয়েছিলেন।
ইহুদীদের একটা বড় অসুবিধা ছিল এই যে, তারা তখনও ছিল একটা যাযাবর সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে তখনও এমন কোনো শক্তিশালী সরকার গড়ে ওঠেনি, যে এই আইনগুলোকে বাধ্যতামূলক ভাবে মানিয়ে নেবার জন্য উপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। যোশী রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইহুদীদের ধর্মীয় নেতা। কিন্তু এই নেতার নেতৃত্ব বজায় রেখে চলা মাঝে মাঝে তার পক্ষে খুবই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু মোশীর সংহিতা ছিল স্বয়ং পরম প্রভু যিহোবার নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং ধর্মীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেকালে অনুরূপভাবে ধর্মের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর কোনো সংহিতা ছিল বলে জানা যায়নি। সেই জন্যই সমাজের লোকের কাছে মোশীর সংহিতা পবিত্র ও অলংঘনীয় বলে গণ্য ছিল। এই জোরেই আইনগুলি কোনোরূপ পরিবর্তন ছাড়াই দীর্ঘকাল ধরে প্রতিপালিত হয়ে আসছিল। আবার এই কারণেই তা আমাদের অগ্রগতির পথে এক দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সে যুগের অপরাধকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা যায়: এক. দেবতাদের বিরুদ্ধে অপরাধ; দুই. রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ; তিন. ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে অপরাধ। বিবাহ, দত্তক গ্রহণ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি যে সমস্ত বিষয় নিয়ে পারিবারিক বিরোধ দেখা দিতে পারে, তাদের সম্পর্কে আইন-কানুন রচিত হয়েছিল। তা ছাড়া বাদ-বিসম্বাদ যাতে এড়িয়ে চলা যায়, সেজন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের শর্তাবলী, ভাড়া, মজুরী ও সুদের হার আইনের সাহায্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে ধার্য করা ছিল।
কিন্তু সে যুগে অর্থনেতিক ক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকরী করা সম্ভবপর ছিল না। তখনকার দিনের আমলাদের এমন সাধ্য ছিল না যে, ব্যক্তিগত ব্যবসায়কে আইনের সুনির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখে। আমাদের বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজেই কি তা পারা যায়? সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসার উপর বেশী চাপ দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments