ইকবাল ভাই
ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বনগাঁ শহরে। তিনিই আমাকে খুঁজে নিয়েছিলেন, না আমিই তাঁকে খুঁজে বের করেছিলাম, সে কথাটা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে খুব অল্প সময়ের ভেতরেই আমাদের দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একথা ওকথা বলতে বলতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক বিয়োগবিধুর ও মর্মস্পর্শী কাহিনী বলে চলেছিলেন। ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে ইতিপূর্বে পরিচয় না থাকলেও আমি তাঁর নাম শুনেছি। তাঁর বাড়ি যশোর জিলার ঝিনাইদহ মহকুমায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে তিনি কোনো এক কলেজে অধ্যাপকের কাজ শুরু করেছিলেন। ভেবেছিলেন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার মধ্য দিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। এর চেয়ে আনন্দময় জীবন আর কি হতে পারে! কিন্তু তাঁর ভাগ্য-বিধাতা তাঁকে দিয়ে অন্য এক খেলা খেলবার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তাঁকে তাঁর অধ্যাপকের শান্ত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এলো। পরবর্তী কালে তার জের টানতে টানতে তাঁকে বেশ কিছু কাল জেলের ভাত খেতে হয়েছিল এবং তার ফলে শেষপর্যন্ত তাঁকে সরকারী প্রভুদের ইঙ্গিতে অধ্যাপকের পদ থেকে বরখাস্ত হতে হলো। অতঃপর তিনি পেটের দায়ে ওকালতী পাশ করে আদালতে যাওয়া-আসা শুরু করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দেশসেবার কাজও চলল। গত নির্বাচনে তিনি তাঁর পার্টি আওয়ামী লীগের টিকেট নিয়ে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য-পদে নির্বাচিত হলেন। কিন্তু, মাত্র এক বছরের মধ্যে তার জের যে কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে, তিনি তা কল্পনাও করতে পারেন নি। জন প্রতিনিধির মর্যাদা আছে, শক্তিও আছে, কিন্তু তাই বলে এতো বড় দায়িত্বের বোঝা নিয়ে চলতে হবে, একথা কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল!
২৫-এ মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার বর্বর আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু এদেশের মানুষ তার কাছে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করে নি। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে যেটুকু শক্তি ছিল তাই নিয়ে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিল। এই প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠল মুক্তিবাহিনী। তারপর থেকে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় পাক-সৈন্যদল আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বেধে চলল। সেই সংঘর্ষ আজও চলছে। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদল ক্ষিপ্ত হয়ে সারা প্রদেশের জনসাধারণের উপর দিয়ে স্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে; আর যারা এই প্রতিরোধ সংগঠিত করে তুলছে, বেছে বেছে তাদের উপর আঘাত হানছে।
ইকবাল ভাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য। সে কারণে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর উপর ওদের বিশেষ দৃষ্টি পড়ল। ওরা সদলবলে তাঁর বাড়িতে হামলা করল। ইকবাল ভাই তার কিছু আগেই সরে পড়েছিলেন। ওরা তাঁর বাড়িঘর ভেঙে-চুরে গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল। তাঁর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এলেন। তারপর সামরিক সরকার তাঁর মাথার উপর দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করল। মুসলিম লীগ আর জামাতে ইসলামের প্রভুভক্ত শিকারী কুকুরগুলি তাঁকে ধরবার জন্য পাঁতি পাঁতি করে খুঁজে বেড়াতে লাগল। শেষকালে ইকবাল ভাই আত্মরক্ষা করবার জন্য এবং তারই সাথে সাথে প্রতিরোধ সংগঠিত গড়ে তোলবার জন্য অন্যান্য বহু সহকর্মীর মত বর্ডার ছাড়িয়ে বনগাঁয় চলে এলেন। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা নানা জায়গায় ঘা খেতে খেতে অবশেষে এসে তাঁর সাথে মিললেন।
ইকবাল ভাইয়ের কাজের শেষ নেই। বর্ডারের এপারে ওপারে তিনি অনবরত ছুটোছুটি করে চলেছেন। কী এত কাজ জানি না, তা আমার জানবার কথাও নয়। তবে এটা লক্ষ্য করে দেখেছি যে, তাঁর অবসর সময় বড়ই কম; তাহলেও তাঁর সেই মূল্যবান সময়ের এক টুকরো ছিনিয়ে নিয়ে তার মধ্যেই বসে তাঁর এই জীবনের একটি করুণ কাহিনী শুনছিলাম। ইকবাল ভাই বলে চলেছেন:
সেদিন ১লা এপ্রিল। মুক্তিবাহিনী তখনও যশোর ক্যান্টনমেন্টকে অবরোধ করে আছে। সেখানে বেঙ্গল আর্মির সৈন্যরা আছে, ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানরা আছে, পুলিশ আছে, আর আছে হাজার হাজার জনতা। তারা সারাদিন আর সারারাত ধরে ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিমা সৈন্যদের ঘেরাও করে আছে। সারা জেলার মানুষ উৎকণ্ঠিত আগ্রহ নিয়ে তার ফলাফল জানবার জন্য প্রতীক্ষা করছে। তখন আমি ছিলাম কালিগঞ্জে-আমার নিজগ্রামে। সেখানে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করছিলাম। সেদিন সকালবেলা আমাদের কালিগঞ্জ বাজারে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। চা খাচ্ছিলাম আর আলাপ করছিলাম। হঠাৎ একটা ভয়ার্ত কলরব শুনে চমকে উঠে দেখলাম, বাজারের লোকগুলি কে জানে কি এক আতঙ্কে বাজার ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। কি হয়েছে, জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কাউকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবার আগেই একটা অতি পরিচিত তীক্ষè ক্বড়-ক্বড়-ক্বড়-ক্বড় শব্দ আমার কানে এসে ঢুকল। কি আশ্চর্য, এ-যে মেসিনগানের আওয়াজ! যুদ্ধ কি তবে এরই মধ্যে আমাদের কালিগঞ্জ গ্রামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না কি! সৈন্য আসছে, সৈন্য আসছে! ওরা গুলি চালাচ্ছে-চারদিকে ভীত-ত্রস্ত জনতা ডাকাডাকি আর ছুটোছুটি করছে, যে যেদিকে পারে সে সেদিকে ছুটে পালাচ্ছে।
সত্য কথাই, একদল সৈন্য এদিকে ওদিকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে। এদের গুলিতে কিছু কিছু লোক নাকি জখমও হয়েছে। ওরা একটু বাদেই হয়তো বাজারের মধ্যে এসে ঢুকে পড়বে। একটু সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম! কিন্তু প্রাণের মায়া বড় মায়া। এক সময় হঠাৎ লক্ষ করলাম আমিও আর সকলের মত দিশাহারা হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছি। ছুটতে ছুটতে গিয়ে একসময় গাছের আড়ালে গুড়ি মেরে বসে রইলাম। ওখানে বসেই দেখলাম, সামনেই ঝিনাইদহের পথ ধরে একদল সশস্ত্র সৈন্য মার্চ করে চলে গেল। না, ওরা এখানে যুদ্ধ করতে আসে নি, লুটপাট করতেও নয়। ওরা গ্রামের লোকদের উপর মেসিনগান চালিয়ে একটু হাতের সুখ করে নিচ্ছে। ওদের সব চেয়ে বড় আনন্দ মানুষ শিকারে। তাছাড়া ওরা লোকের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবার ও তাদের মনোবল ভেঙে দেবার উদ্দেশ্যে যে-ভাবে খুশি সেই ভাবেই গুলিবর্ষণ করে চলেছে।
এভাবে কতো লোক মারা গেছে, আর কতো লোক জখম হয়েছে, তাই বা কে জানে! চিন্তিত মনে ধীরে ধীরে ফিরে এলাম বাড়ির দিকে। আসতে আসতে দেখলাম, সৈন্যরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে গ্রামের লোকদের মুখে আবার হাসি দেখা দিয়েছে। যাক, এ যাত্রা তো বাঁচা গেল, এই বলে সবাই নিজেদের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই পত্তনি বাড়ির ভেতরে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে।
এ আবার কি! কারা কাঁদছে, বুকটা ভয়ে ধড়াস্ করে উঠল। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখি, যা ভয় করেছিলাম তাই, কান্নার শব্দটা আমাদের বাড়ি থেকেই আসছে। আরও কাছে গিয়ে দেখি উঠানের মাঝখানে শুয়ে আছে জেণ্ডার। না জেণ্ডার নয়, জেণ্ডারের মৃত দেহ। ওর কাপড়-চোপড় রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে। অনেক লোক ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর মা শাবক-হারা পাখির মতো সেই ধূলোবালির উপর যেন পাখা ঝাপটে ঝাপটে মরছে। জেণ্ডারের কচি মুখখানির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আরো যেন কি বলতে যাচ্ছিলেন ইকবাল ভাই, কিন্তু বলতে গিয়ে বলতে পারলেন না। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তাঁর বুকের মধ্যে যেন এক ঝড় বইছে। কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে কেটে যাওয়ার পর আমি মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, জেণ্ডার! জেণ্ডার কে?
জেণ্ডার? জেণ্ডার আমার ছোট ছেলে। ওর নাম শুনে আশ্চর্য হয়েছেন? ওর যখন জন্ম হয় তার ক’দিন আগে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে, এক বিরাট পুরুষ আমাদের ঘরে এসে ঢুকছেন। ঘুম থেকে জেগে উঠে আমার স্ত্রীকে বললাম, যদি আমার ছেলে হয়, তবে তার নাম দিও আলেকজাণ্ডার। দিগি¦জয়ী আলেকজাণ্ডারের মতো সে এক মহাশক্তিশালী পুরুষ হবে। পরে যখন ছেলে হলো, তখন সত্যি সত্যিই নাম দিয়েছিলাম আলেকজাণ্ডার।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments