তিতুর সেই গানটি
এককালে এই গানটি আমার খুবই পরিচিত ছিল। শ্রমিকদের সভায়, মিছিলে নানা উপলক্ষেই এই গানটি গাওয়া হতো। প্রায় ৩০ বছর আগেকার কথা। ইতিমধ্যে আমার স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে সেই গানের অধিকাংশ পদগুলি খসে ঝরে পড়ে গিয়েছে। মাত্র প্রথম স্তবকটি আজ মনে পড়ছে। কিন্তু তাও সম্পূর্ণ নয়, দুর্ভাগ্যক্রমে তার প্রথম কলিটির কয়েকটি শব্দ হারিয়ে গিয়েছে। আর যেটুকু মনে আছে, তার মধ্যেও ভুল-ভ্রান্তি থাকার সম্ভাবনা আছে।
সত্যি কথা বলতে কি, এতকাল আমার এই প্রিয় গানটির কথা একেবারে ভুলেই ছিলাম। মনে করিয়ে দিল তিতু, আমার এক বিশিষ্ট বন্ধুর ছেলে তিতু। তিতুদের বাড়ি যশোর জেলায়।
গত বছর কি একটা উপলক্ষে তিতুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তিতুর সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। তখন তিতু ছয় বছরের ছেলে। ডাগর ডাগর চোখ, সেই চোখ দু’টি থেকে বুদ্ধির দীপ্তি ঝরে পড়ছে। আর ওর মুখশ্রীতে এমন কিছু আছে, যা থেকে মনটা আপনি মমতায় ভরে আসে। এই গানটি তিতুর খুবই প্রিয় গান। তিতুই আমাকে গানটার কথা মনে করিয়ে দিল।
তিতু গান গাইতে বড় ভালবাসে। বিশেষ করে এই গানটা। তিতুর এক বন্ধু আছে। ওরা একবয়সী নয়, বন্ধুর বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। এক সময় তিনি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন। তার পুরস্কারস্বরূপ বহুবার জেলও খেটেছেন। আজও তাঁকে সভা-সমিতিতে, মিছিলে যোগ দিতে দেখা যায়। এই গানটি তিতু তার সেই বন্ধুর কাছ থেকে শিখেছে।
তিতু তার এই অসমবয়সী বন্ধুটির স্খলিত, কম্পিত কণ্ঠস্বরে সুর মিলিয়ে এই গানটি গাইত। শুধু গাওয়া নয়, আমার ভাগ্য ভালো, আমি তাকে একদিন এই গানের সাথে নাচতেও দেখেছি।
সে একা নয়, সঙ্গে তার বন্ধুটিও ছিল। শিশুর মত সরল আর তাজা মন সেই বৃদ্ধটি কোমরে একটি পেটি, আর মাথায় একটা গামছা বেঁধে, বদ্ধমুষ্টি ঊর্ধ্বে তুলে নাচতে নাচতে গাইছিলেন,
‘মেহনত কাস্...
হাত মে ঝাণ্ডা লাল উঠা
জুলুম কা নাম নিশান মিটা
হোস্মে আ বেদার হো জা’
তিতুও সেই একই সাজে সেজে তার বন্ধুকে অনুসরণ করে নাচছিল আর গাইছিল। এমন দৃশ্য সুলভ নয়। সৌভাগ্যক্রমে ওরা আমাকে দেখতে পায় নি, আড়ালে দাঁড়িয়ে এই উপভোগ্য দৃশ্যটা দেখে নিলাম।
তারপর একটা বছর কেটে গেছে। তিতু এখন সাত বছরের ছেলে। তিতুর সঙ্গে সেই দেখাই শেষ দেখা। মাসকয়েক আগেকার কথা বলছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাহ প্রদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তরঙ্গিত হয়ে বয়ে চলেছে। তার উত্তরে জঙ্গী-বাহিনীর অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেছে। তাদের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক ভারত-সীমান্তের এপারে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।
আমিও তাদেরই একজন। ঘটনাচক্রে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল আমার সেই সহকর্মী বন্ধু তিতুর আব্বার সঙ্গে। তিনিও আমার মতোই একজন শরণার্থী। তাঁর মুখেই তিতুর কথা শুনলাম। তিনি তাঁর এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন। তিতু নামটা সেই প্রসঙ্গে এসে গেল। সেই কাহিনীটা তাঁর জবানীতেই বলছি। তিনি বলছিলেন :
সেই দিনটির কথা কোনোদিন ভুলে যেতে পারব না। তারিখটা ছিল ২৯-এ মার্চ। তার আগেই ২৫-এ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের উপর ওদের বর্বর হামলা নেমে এসেছে। তারপর শহরের পর শহরে ওরা ওদের হিংস্র আর রক্তাক্ত থাবা বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যশোর শহরে ওরা এখনও আক্রমণ শুরু করে নি। কি ভাবছে ওরা মনে মনে, কে জানে! শহরের স্তব্ধ আবহাওয়াটা যেন একটা গুরুভার পদার্থের মত আমাদের উপর নেমে আসছে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে হাজার হাজার সৈন্য। তাদের মধ্যে অস্থিরতা আর কর্মব্যস্ততা প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতিটি দিন সৈন্যবাহী ট্রাকগুলি শিকারের উদ্দেশে এদিকে, ওদিকে, নানা দিকে ছুটে চলেছে। কিন্তু যশোর শহরকে কি একদিন ওদের আক্রমণের শিকার হতে হবে না? হবে বৈকি, নিশ্চয়ই হবে। কবে আসবে সেই দিন, আমরা মনে মনে সেই বিভীষিকার চিত্র কল্পনা করে শিউরে উঠি, আর সশঙ্কচিত্তে দিন গুণে চলি।
সারা বাংলাদেশের মতো যশোরেও সামরিক সরকারের সঙ্গে পূর্ণ অসহযোগ চলছে। সামরিক সরকার আর কখনো জনসাধারণের কাছ থেকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নি। নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয় ও সংগ্রামী অসহযোগ। সরকারের অস্তিত্ব যেন থেকেও নেই, তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে এবং কার্যত বাতিল করে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ফরমানের পর ফরমান জারী করে চলেছেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চতম সরকারী অফিসাররা পর্যন্ত সেই সমস্ত নির্দেশ নতমস্তকে মান্য করে চলেছে। এমন এক বিচিত্র ঘটনা!
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে সক্রিয় অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। যশোর জেলার সাধারণ মানুষ-চাষী, মজুর, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী সকল সম্প্রদায়ই এই আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। তাদের বয়কট আন্দোলনের ফলে ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যদের জন্য রসদপত্র আসতে পারছে না। সরকারী প্রভুরা আর তাদের দালালরা খাদ্য-সংগ্রহের জন্য বহু চেষ্টা করেও হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে ক্যান্টনমেন্টের হাজার হাজার সৈন্য এক মহা-সঙ্কটের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
শহরে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, এখানকার অবাঙালি আর বাঙালিদের মধ্যে শীঘ্রই নাকি দাঙ্গা বাধবে। কে বা কারা এই গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সে কথা কেউ পরিষ্কারভাবে বলতে পারে না, তবে এই গুজবের ফলে শহর বেশ গরম হয়ে উঠেছে। ২৯-এ মার্চ সকালবেলা একটা অবাঙালি পাড়া দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ লোকের মুখে মুখেই একটা আওয়াজ ভেসে এল, ‘দাঙ্গা বেধে গেছে’, ‘দাঙ্গা বেধে গেছে।’ পথের মানুষ ভয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। যে যেদিকে পারে, সেদিকে ছুটছে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জনকয়েক সৈন্য দ্রুতপদে চলে আসছে। চলে আসছে নয় ছুটে আসছে। এ-সময় বাইরে থাকা কোনোমতেই নিরাপদ নয়। সামনে যে-বাড়িখানা, গিয়ে উঠে পড়লাম। একা আমি নই-আমার মতো আরও পাঁচ-ছয় জন পথচারী একই সঙ্গে সেখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে সেই সৈন্যরা এসে গিয়েছে। ওরা দূর থেকেই আমাদের দেখতে পেয়েছিল। ওদের চোখ আর রোখ আমাদের উপর পড়েছে। কোনো কথা নয়, ওরা লাফ দিয়ে বারান্দার উপর উঠে পড়ল, তারপর উদ্যত সঙ্গীনের মুখে, একদল পশুর মত তাড়া করে আমাদের পথের উপরে নিয়ে জড় করল। তারপর শুরু করল মারতে।
উঃ, সে কি প্রচণ্ড মার! মানুষ মানুষের উপর মারপিট করে, এটা কোনো নতুন কথা নয়। মারতে মারতে মেরে ফেলে এমন কথাও অনেক শুনেছি, কিন্তু সেই জিনিসটা-যে কেমন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা কোনোদিন অনুভব করতে হয় নি। এদের মধ্যে কেউ বেয়নেট, কেউ বা বন্দুকের কুঁদা দিয়ে নির্দয়ভাবে মেরে চলেছিল। প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল আমার হাড়গুলি যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য বেদনায় আমার চিৎকার করার শক্তিটাও যেন লোপ পেয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে ঝাপ্সা দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাব। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়াটাই ভালো ছিল। পড়েও গিয়েছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জ্ঞান হারাই নি। জ্ঞান হারালে এতটা দুর্ভোগে ভুগতে হতো না। ওরা আমাদের মাটির উপর ফেলে বুটের তলায় মারতে লাগল, যেমন করে চাষীরা তাদের পায়ের তলায় ধান মাড়ায়। মনে হচ্ছিল গায়ের মাংস যেন হাড় থেকে আলাদা হয়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাদের মারছিল, আর অশ্লীল ভাষায় গাল দিয়ে চলছিল। ওদের কথায়ই বুঝতে পারলাম জনসাধারণের অসহযোগের ফলে ওরা গত কয়েকদিন ধরে পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না, সেই রাগের জ্বালাটা আমাদের উপর দিয়ে মিটিয়ে নিচ্ছে।
অবশেষে ওরা আমাদের অর্ধ-চেতন দেহগুলিকে হেঁচড়ে টানতে টানতে থানার ভেতরে নিয়ে গেল। তখন এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments