সোনাইমুড়ি রেলস্টেশনে
চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর রহমান নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলেছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাক-সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারীর মতো তীক্ষè সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলেছে।
আঘাতের পর আঘাত হানো-কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে, কখনও সামনে থেকে, কখনও বা পেছন থেকে। ওদের অস্থির আর পাগল করে তোলো। ওদের কোনো সময় স্বস্তিতে বা শান্তিতে থাকতে দিও না, ওদের প্রতিটি মুহূর্ত দুর্ভাবনায় কাটুক। ওরা যেন ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠে। মুক্তিবাহিনী এই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে চলেছিল। তারা হামলাকারীদের নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করতে দেবে না, নিজেরাও বিশ্রাম নেবে না।
এপ্রিলের শেষ ভাগ। খবর এলো, একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছবে। লুৎফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হলো, ওদের বিনা বাধায় এগোতে দেওয়া হবে না, সোনাইমুড়ি স্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেলস্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সেজন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়-ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফস্কে যেতে দেওয়া চলবে না।
কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের মতো সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবে না। এবার আর আগেকার মতো আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ চলবে দিবালোকে প্রকাশ্যে, মুখোমুখি। ওদের সৈন্যসংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাইমুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে, সৈন্যদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেকটা বেশী। তা হোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্যবাহী ট্রেনটা সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোনো একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌঁছবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ির ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। ড্রাইভার ইঞ্জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল। ফলে ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।
প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাক-সৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারে নি। তারপর ঘটনাটা এমন দ্রুত ঘটে গেল যে, একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্ধ হয়ে রইল। পর মুহূর্তেই তারা তাদের রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুড়মুড় করে কামরা থেকে প্ল্যাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ দিতে হলো।
এবার দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপরে এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায় নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এই লড়াই চলল। এই যুদ্ধে পঁয়ত্রিশজনের মত পাক-সৈন্য নিহত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছয়জন শহীদ হলেন।
ইতিমধ্যে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পেয়ে ঘণ্টা তিনেক বাদে আক্রান্ত পাক-সৈন্যদের সাহায্য করবার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছল। এবার পাক-সৈন্যদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল আড়াই শতের উপরে। হতাহতদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশ-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মাত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভুল কখনও করে না। তারা যেমন বিদ্যুৎগতিতে এসে আক্রমণ করেছিল, তেমনি ভাবেই ঘটনাস্থল থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পাক-সৈন্যরা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments