মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর
গভীর রাত্রিতে ওরা দিনাজপুর শহরে এসে ঢুকল। এ রাত্রি সেই ২৫-এ মার্চের রাত্রি, যে-রাত্রির নৃশংস কাহিনী পাকিস্তানের ইতিহাসকে পৃথিবীর সামনে চির-কলঙ্কিত করে রাখবে।
ওরা সৈয়দপুর থেকে এসে অতি সন্তর্পণে শহরের মধ্যে ঢুকল। শ’খানেক পাঞ্জাবী সৈন্য। শহরের ঢোকার মুখে প্রথমেই থানা। সৈন্যরা প্রথমে থানা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। তারপর তারা তাদের পূর্ব-নির্ধারিত পরিকল্পনা-অনুসারে শহরের টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো। সেইদিনই শেষ রাত্রিতে দিনাজপুরের বিখ্যাত কৃষক নেতা গুরুদাস তালুকদার এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক তাদের হাতে গ্রেফতার হলেন। এমন নিঃশব্দে ও সতর্কতার সঙ্গে এ সমস্ত কাজ করা হয়েছিল যে, শহরের অধিকাংশ লোক তার বিন্দুমাত্র আভাস পায় নি।
পরদিন সকাল বেলা তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে জানল, পাক-সৈন্যরা তাদের দিনাজপুর শহর দখল করে নিয়েছে। এখন থেকে এখানকার সবকিছু তাদের নির্দেশ মতোই চলবে।
আরও শুনল, বেলা ১১টা থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারফিউ আদেশ ঘোষণা করা হচ্ছে। দিনরাত অষ্টপ্রহর ধরে কারফিউ চলবে। শহরের রাজপথ জনশূন্য, কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া-শব্দ নেই। সবাই যে যার ঘরে মাথা গুঁজে বসে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা করে চলেছিল। সারাটা দিন এইভাবে কাটল। কিন্তু রাত্রি বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই ভীতত্রস্ত মানুষগুলির মনের পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল, তারা মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুহুর্মুহুঃ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। শহরে যে-সব জায়গায় মেহনতী মানুষদের বাস, সেই সব জায়গা থেকেই সবচেয়ে বেশী আওয়াজ উঠছিল। দম বন্ধ করা সেই ভয় ও দুর্ভাবনার বোঝাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ প্রাণ খুলে তার প্রাণের কথা বলতে চাইছিল। রেল চলাচল, ডাক, টেলিগ্রাফ, সবকিছু বন্ধ অথচ খবরগুলি যেন বাতাসে উড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন করে এই সমস্ত সংবাদ এলো কেউ তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না, কিন্তু ২৭ তারিখের মধ্যেই এ কথাটা মোটামুটি সবাই জেনে ফেলছে যে, বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। শহরের লোকদের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনা তাদের ভয়কে ছাপিয়ে উঠছে। এটা সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে যে, এই মুক্তিসংগ্রামে সকলেরই যোগ দেওয়া উচিত, কিন্তু সাধারণ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ, তারা কি করে জঙ্গী-বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে!
২৬-এ মার্চ থেকে ২৮-এ মার্চ পর্যন্ত একটানা ভাবে দিনরাত কারফিউ চলছিল, মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে।
এদিকে পাক-সৈন্যরা নিশ্চিন্তে ছিল না। জনসাধারণ জানুক আর না-ই জানুক, এক মহাসঙ্কট সৈন্যদের মাথার উপর খড়গের মতো ঝুলছিল। এক প্রবল বিরোধী শক্তি তাদের উদ্ধত হয়ে আছে, যে-কোনো সময় তা এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। দিনাজপুরে ই. পি. আর. বাহিনীর পাঁচ শ জওয়ান আছে। সৈন্যদের সংখ্যা মাত্র এক শ। এখানে আপাতত তারা শান্ত হয়ে আছে বটে, কিন্তু তাদের মনোভাব অজানা নয়। পূর্ববঙ্গে সর্বত্র এই ই. পি. আর. বাহিনী বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রধান শক্তি। কাজেই সময় থাকতেই এদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে ফেলা দরকার। প্রয়োজন হলে এদের কচু-কাটা করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। সামরিক সরকার প্রদেশের সর্বত্রই এই নীতি অনুসরণ করে চলেছে।
কিন্তু মাত্র এক শ সৈন্য ই. পি. আর.-এর পাঁচ শ জওয়ানকে নিরস্ত্র করবে অথবা বন্দী করবে, অথবা কচু-কাটা করবে, এটাই বা কেমন করে সম্ভব? সৈন্যদের নেতৃস্থানীয়েরা বুদ্ধি করল, এক্ষেত্রে সরাসরি বলপ্রয়োগ না করে ওদের কৌশলে ডেকে এনে ফাঁদে ফেলতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটা বড় রকম ভোজের আয়োজন করে তারা ই. পি. আর. বাহিনীর জওয়ানদের সাদর আমন্ত্রণ জানালো। সৈন্যদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন আদর-আপ্যায়নের ঘটা দেখে ই. পি. আর. বাহিনীর লোকেরা মনে মনে হাসল। ওদের মতলবখানা বুঝতে কারও বাকী ছিল না। ওরা এই ক’দিন ধরে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছিল। এবার আর দেরী না করে তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।
আমন্ত্রিতেরা সদলবলে তাদের ঘাঁটি থেকে দিনাজপুর শহরে চলে এলো। তবে ভোজসভায় নয়, রণক্ষেত্রে। তারা ২৮-এ মার্চ বেলা ৩টায় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সারা শহর মুখরিত করে শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝটিকার বেগে আক্রমণ করল। হঠাৎ এভাবে আক্রান্ত হয়ে উদ্ভ্রান্ত পাক-সৈন্যদের অধিকাংশ ‘সার্কিট’ হাউসে গিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। অন্যান্যেরা ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে শহরের নানা জায়গায় আশ্রয় নিলো। কিন্তু শহর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ই. পি. আর. বাহিনীর যোদ্ধারা আর শহরের মানুষ এই পলাতক দস্যুদের সেই সমস্ত আশ্রয় থেকে টেনে টেনে বার করতে লাগল। তাদের খতম করে ফেলতে খুব বেশী সময় লাগল না। কিন্তু সার্কিট হাউসের মধ্যে অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা ৩০-এ মার্চ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করে চলেছিল। এই তিন দিনের যুদ্ধে তাদের মধ্যে মাত্র সাতজন ছাড়া আর সবাই মারা পড়ল। ৩১-এ মার্চ তারিখে সেই সাতজন সৈন্য মরীয়া হয়ে একটা গাড়ি নিয়ে অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে পড়ল। এইভাবে তারা মৃত্যুর গহ্বর থেকে প্রাণ বাঁচাল। শোনা যায় ঐ গাড়ির মধ্যে কর্নেল তারেকও নাকি ছিলেন।
মুক্ত হলো দিনাজপুর শহর। সারা শহর জুড়ে বিজয়-উৎসব চলল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা জানত, এই উৎসব নিয়ে মত্ত থাকলে চলবে না। মুক্তিসংগ্রামের এই তো সবে সূচনা। দেশকে মুক্ত করতে হলে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চলতে হবে। সেই সংগ্রাম আজও চলছে, আরও বহুদিন ধরে চলবে, যতদিন পর্যন্ত আমরা এই শত্রুদের আমাদের দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে দিতে না পারি।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments