হাজং আন্দোলনের প্রধান দুর্গ লেংগুরা

লেংগুরা কলমাকান্দা থানার একটি গ্রাম। গুণেশ্বরী নদীর তীরবর্তী এই গ্রামটি হাজং-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ ও সরকারের দৃষ্টির সামনে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। শুধু লেংগুরা নয়, এই লেংগুরকে কেন্দ্র করে গুণেশ্বরীর এপারে ওপারে কৃষক আন্দোলন ব্যাপকভাবে ও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত হয়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে বহু সচেতন ও সক্রিয় কর্মী লাল ঝাণ্ডার নীচে এসে সমবেত হয়েছিল। সমগ্র পাহাড় অঞ্চলে সংগ্রামী হাজং-কৃষকদের এইটিই ছিল সর্বপ্রধান দুর্গ।

এই লেংগুরা অঞ্চল আরও একটি ঐতিহ্য বহন করে আসছিল। এই অঞ্চলের হাজং কৃষকরা ইতিপূর্বে আরও একটি আন্দোলন করে এসেছে। তবে সেই আন্দোলন কৃষকের অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়া নিয়ে নয়, সেই আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলন—সমগ্র ভারত ব্যাপী বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রবাহ এখানকার মাটিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের পলিমাটি রেখে গিয়েছিল, যার ফলে এখানকার মাটি ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পক্ষে উর্বর হয়ে উঠেছিল।

১৯৩০ সালের সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন লেংগুরা হাজংনেতা ললিত সরকার। সে সময় তার বয়স বছর পঁত্রিশের মতো। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে তাকে এবং তার মতো আরও অনেক হাজং কৃষককে সরকারী পুলিশের হাতে বহু উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। যার ফলে এই অঞ্চলের হাজং-কৃষকদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছিল। দেশ স্বাধীন না হলে কৃষকদের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হতে পারে না, এই সত্যটি তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পেরেছিল। সেই জন্যই তাদের শ্রেণী-আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন প্রথম থেকেই একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে চলেছিল।

ললিত সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকলেও মনি সিং তাঁর নাম শুনেছিলেন। টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলন শুরু করবার পরই তিনি এই বিষয়টি নিয়ে ললিত সরকারের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য চলে গেলেন লেংগুরায়। তিনি একথাটা জানতেন যে, স্থানীয় হাজং-কৃষকদের উপর ললিত সরকারের যথেষ্ট প্রভাব আছে। তাকে যদি একবার এই পথে নামানো যায়, তাহলে হাজং-কৃষকদের মধ্য এই আন্দোলন দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়বে। এই লক্ষ্য সামনে নিয়ে তিনি লেংগুরায় ললিত সরকারের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। শুধু যে উঠলেন তা নয়, সেখানে ভালোমত ঠাঁই করে বসলেন। বেশ কয়েক দিন ধরে দুজনের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলল। শুধু টংক প্রথা নিয়ে নয়, স্বাধীনতা, এ দেশের কৃষক-সমাজের ভবিষ্যৎ, সমাজতন্ত্রবাদ—আলাপ চলল সব কিছু নিয়েই। ললিত সরকার সচেতন ভাবে না হলেও আগে থেকেই এ দিকে উন্মুখ হয়ে ছিল, এবার একটু ঘা পড়তেই তাঁর মনের তন্ত্রীগুলি অনুরূপ সুরে ঝংকার দিয়ে উঠল। এক শুভ লগ্নে তাঁদের এই যোগাযোগ ঘটেছিল। এই যোগাযোগের ফলেই ললিত সরকার প্রথমে টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলন এবং পরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক আন্দোলনে দৃঢ় পথক্ষেপে এগিয়ে এলেন।

ললিত সরকার সম্পন্ন কৃষক। কিছু কিছু লেখাপড়া জানতেন, দেশের খবরাখবরও রাখতেন। ব্যক্তিগত জীবনের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে এই পথে টেনে নিয়ে আসে নি। তিনি ছিলেন স্থানীয় কৃষক-সমাজের নেতা তাদের প্রতিনিধি স্থানীয় এবং তাদের সেবক। এই দারিদ্র্যক্লিষ্ট কৃষকদের উপর দীর্ঘ দিন থেকে যেই শোষণ ও অত্যাচার চলে আসছিল, তাঁর দরদী মন সে সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে নি। সেই জন্যই মনি সিং-এর এই সংগ্রামী আহ্বানে সাড়া দেবার জন্য তিনি আগ্রহে এগিয়ে এলেন।

ক্রমে-আন্দোলনের নিজস্ব গতিবেগে এবং কর্মীদের নিষ্ঠা ও সাধনার ফলে শুধু লেংগুরা বা কলমাকান্দা থানা এলাকার মধ্যে নয়, আন্দোলন দেখতে দেখতে সমস্ত পাহাড়-অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। তা হলেও একথা সবাই স্বীকার করবে, এই লেংগুরা অঞ্চলই ছিল এই ব্যাপক সংগ্রামী আন্দোলনের প্রধান দুর্গস্বরূপ। এই লেংগুরাকে কেন্দ্র করেই সংগঠন সব চেয়ে মজবুত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

হাজং-কৃষকরা শুধু যে টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলন করেছে, তা নয়, তাদের অভাব অভিযোগ এবং কৃষক-জীবনের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে হয়েছে। সমস্ত হাজং অঞ্চলের পক্ষে যা সত্য, তা লেংগুরার পক্ষেও সত্য, আর এই সমস্ত আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন উপলক্ষ্যে কখনও জমিদার পক্ষের সঙ্গে, কখনও বা সরকার পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে নামতে হয়েছে।

লেংগুরার বাজার অনেক দিনের পুরানো বাজার। হাজং, গারো এবং অন্যান্য উপজাতীয় লোকেরাই এখানকার ক্রেতা ও বিক্রেতা। বাজারের রকমটা এখনও পুরানো দিনের মতোই আছে। সমতল ভূমির বাঙালী’ ব্যবসায়ীদের তখনও নানা রকম চটকদার জিনিষের ‘লালচ’ দেখিয়ে মন ভুলিয়ে সরল প্রাণ উপজাতীয় লোকদের ট্যাঁক কাটতে শুরু করে নি। এখনকার কথা নয়, আজ থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা।

বাজারের মালিক সুসঙের জমিদারবাড়ির মধ্যম হিস্যা। বাজারের গা ঘেঁষে তাঁদের এক বিরাট কাচারী ঘর। কিন্তু বাজার থেকে জমিদারের কোন মুনাফা ওঠে না। যারা এ সমস্ত বাজারে জিনিষপত্র বিক্রী করতে থাকে, তাদের কাছ থেকে কোনো খাজনা নেওয়া বা তোলা আদায়ের রেওয়াজ কোনো দিনই ছিল না। জমিদারের লুব্ধ দৃষ্টি এবার এদিকে পড়েছে। মাঝে মাঝে খাজনা আদায়ের প্রস্তাবটা তুলেও দেখেছে। কিন্তু কথাটা তোলার সাথে সাথে এখানকার সাধারণের কাছ থেকে প্রবল প্রতিবাদ এসেছে যে, তারা আর এই নিয়ে বেশী দূর এগোতে সাহস করে নি। এতদিন ধরে তারা যেই অধিকার ভোগ করে এসেছে, তা কি এত সহজেই ছেড়ে দেবে! এখানে কৃষকদের সংগঠন এতই শক্তিশালী যে, তাদের বাধা অগ্রাহ্য করবার আগে দশবার চিন্তা করে নিতে হয়। জমিদার পক্ষ কিছুকাল চুপ মেরে থাকলেও ভিতরে ভিতরে ফন্দি আঁটছিল।

১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে নেত্রকোণায় নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনকে সমস্ত দিক দিয়ে সফল করে তুলবার জন্য সারা অঞ্চলের নেতা ও কর্মীরা অনেক দিন আগে থেকেই সম্মেলনের জায়গায় উপস্থিত হয়ে কাজ করে চলেছিলেন। ইতিমধ্যে কোন্ কোন্ অঞ্চলে কি কি ঘটনা ঘটে চলেছে, সে সব কথা জানবার মতো আগ্রহও ছিল না, উপায়ও ছিল না।

লেংগুরায় তখন নাম করবার মতো কেউ নেই, সবাই চলে গেছে সম্মেলনের আয়োজনে। জমিদার পক্ষ দেখল, এইটাই সুবর্ণ সুযোগ, যা করবার তা এর মধ্যেই করে ফেলতে হবে। খাজনা আদায়ের ব্যাপারটাকে একবার চালু করে ফেলতে পারলে, কেউ আর তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তারা এই নিয়ে পাঁচ মাথা এক হয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ চালাতে লাগল, মধ্যম হিস্যার কাচারীঘর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল।

কিন্তু এতদিনের পুরানো বাজারে তারা খাজনা বা তোলা আদায়ের নূতন ব্যবস্থা চালু করতে সাহস করল না। তাই তারা অত্যন্ত তাড়াতাড়ি পুরানো বাজারের পাশেই এক নূতন বাজার গড়ে তুলতে লাগল। এই বাজার থেকেই নূতন প্রথা শুরু করা হবে। ওদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় নেতাদের মধ্যে চারজন লেংগুরায় চলে এলেন। এই চারজন মণি সিং, ভূপেন ভট্টাচার্য, পুলিন বক্্সী আর আলতাব আলী।

তাঁরা প্রথমেই এসে লেংগুরার বাজারে উঠলেন। কিন্তু বাজারের দিকে তাকিয়ে তাঁরা নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কি আশ্চর্য কাণ্ড, মাত্র মাস দুই কাল তাঁরা এই অঞ্চলের বাইরে ছিলেন, এরই মধ্যে পুরানো বাজারের পাশেই এক সুদৃশ্য নূতন বাজার গড়ে উঠছে! সেই সাথেই আরও একটা জিনিস তাদের চোখে পড়ল। পুরানো বাজারের চালাঘরগুলোর খুঁটি ভেঙ্গে তাদের মাটির সঙ্গে সমান করে দেওয়া হয়েছে। এবার এর পিছনকার ষড়যন্ত্রটা বুঝতে তাঁদের বাকী রইল না। এইরকম একটা গোপন পরিকল্পনার কথা ইতিপূর্বেই তাঁদের কানে এসেছিল, কিন্তু তাদের এত বড় দুঃসাহস হবে, এটা তাঁরা ভাবতে পারেন নি।

তাঁরা বুঝলেন, জমিদার পক্ষ এবার শক্তি পরীক্ষার জন্য চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। এই সঙ্কল্প নিয়ে তাঁরা সেই

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice