ময়মনসিংহের হাজং আন্দোলন
একদিকে বাংলাদেশ, আর একদিকে আসাম। এই দুয়ের মাঝখানে সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে গারো পাহাড়। দীর্ঘ পাহাড়ের মালা এঁকেবেঁকে পথ করে চলেছে দূর থেকে দূরে, বহু দূরে। সমতল অঞ্চলের মানুষ দূর থেকে সেই দিগন্ত-বিস্তারী নীলাঞ্জন রেখার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। পর্বত নয়, পাহাড়। তাহলেও তার শোভা বড় কম নয়।
গারো পাহাড় ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে চলে গিয়েছে। সদর নেত্রকেকোণা আর জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলার এই তিনটি মহকুমা এই পাহাড়ের গায়ে এসে মিশেছে। প্রস্থে পাঁচ মাইল, আর দৈর্ঘে সত্তর মাইল, পাহাড়ের গা-ছোঁয়া এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি লোকের মুখে মুখে পাহাড় অঞ্চল নামে পরিচিত। গারো উপজাতির নাম থেকেই এই গারো পাহাড়ের নামের উৎপত্তি। কিন্তু শুধু গারোই নয়, গারো ছাড়াও হাজং, বানাই, ডালু, কোচ, বংশী প্রভৃতি নানা উপজাতীয় লোকেরা দীর্ঘকাল থেকে এই পাহাড় অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। কিন্তু সেই দীর্ঘকাল যে কতকাল তার সঠিক কোনো হিসেব আমাদের হাতে নেই।
সুসঙ দুর্গাপুরের জমিদাররা দীর্ঘদিন ধরে এই গারো পাহাড় ও পাহাড় অঞ্চলের মালিকানা ভোগ করে আসছিল। অপর দিকে এই পাহাড় অঞ্চল একমাত্র বাংলার আদিবাসীদেরই বাসভূমি ছিল। বাঙালিদের মধ্যে কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ এর ধারেকাছেও ঘেঁষতো না। সভ্যতার আলোক এবং নানা জটিলতা ও শোষণের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই প্রকৃতির সন্তানরা বংশ বংশ ধরে তাদের সহজ-সরল জীবন যাপন করে চলেছিল। কিন্তু সভ্যতা কাউকে ছেড়ে দেয় না, শেষ পর্যন্ত তার সর্বগ্রাসী আলিঙ্গনের মধ্যে টেনে নিয়ে আসে। এই পরিণতি অনিবার্য, বাঞ্ছনীয়ও বটে। কিন্তু এর পিছনে বহু অত্যাচার, শোষণ, লাঞ্ছনা ও ধ্বংসলীলার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে থাকে। এখানকার গারো, হাজং প্রভৃতি আদিবাসীরা সুসঙ দুর্গাপুরের জমিদারদের মালিক বলে জানত, মানত কিন্তু প্রজা হিসেবে ভিটেমাটি বা খেত-খামারের জমির জন্য তাদের কোন রকম খাজনা দিতে হত না। তারা জানত, ভগবানের দেওয়া আলো-বাতাসের মতো এই মাটিকেও তারা জন্মসূত্রে স্বাভাবিকভাবে পেয়ে এসেছে। এই অধিকার তাদের জন্মগত অধিকার, এই অধিকার থেকে কেউ তাদের বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু তাহলেও জমিদার তাদের মালিক, এই সত্যটাকেও তারা জন্মগত সংস্কারের বশে স্বাভাবিক বলে মেনে চলে আসছিল। মালিক হিসেবে তাদের অবশ্যই কিছু প্রাপ্য আছে ভেবে সেই প্রাপ্যটা তারা যথা-নিয়মে চুকিয়ে দিয়ে আসছিল। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি।
জমিদার ছিলো এই পাহাড়ের বিপুল অরণ্য সম্পদের মালিক। এ থেকে তাদের প্রচুর আয় হত। এছাড়া তাদের আর একটা আয়ের পথ ছিল হাতীর ব্যবসা। বর্তমানে এখানে হাতীর বংশ লোপ পেয়ে গেছে। কিন্তু এক সময়ে এই গারো পাহাড়ে দলে দলে হাতী নিঃশঙ্ক চিত্তে বিচরণ করত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই বন্য হাতীদের ধরবার ব্যবস্থা করা হতো। প্রচলিত ভাষায় এর নাম হাতী-খেদা। হাতী-খেদার সময় বহু লোকের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। শত শত লোককে অনেক দূর থেকে হাতীর দলকে ঘেরাও করে নিয়ে মিলিত কণ্ঠে চিৎকার করে ও নানা রকম বিকট আওয়াজ তুলে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসতে হয়। দিনের পর দিন ধরে এই কাজ চলতে থাকে। হাতী-খেদার সময় এই কাজের জন্য আদিবাসী প্রজাদের ডাক পড়ত। এ কাজের জন্য তাদের কোনো পারিশ্রমিক দিতে হত না। প্রজারাও বিনা বাক্যে মালিকের এই প্রাপ্য চুকিয়ে আসত। এ ছাড়া জমিদার আর তার প্রজাদের মধ্যে আদান-প্রদানের আর কোন সম্পর্ক ছিল না।
গত শতাব্দীর মধ্যভাগে গারো পাহাড়ের এই অরণ্য সম্পদের দিকে বৃটিশ বণিকদের লুব্ধ দৃষ্টি পড়ল। বৃটিশ ভারতের সরকার এই গারো পাহাড় এলাকার উপর তাদের মালিকানার দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। এই নিয়ে জমিদারের সঙ্গে চললো মামলা। কিন্তু এদের হাতে মুগল আমলের যে সমস্ত কাগজপত্র ছিল, তাদের কাছে ঠোক্কর খেয়ে সরকার এই মামলায় এঁটে উঠতে পারছিলেন না। মামলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত তারা প্রিভী কাউন্সিলের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু সেখানেও তাদের হার মানতে হলো। বৃটিশ ভারতের সরকার এতেও ক্ষান্ত হলেন না। এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে, শুধু অরণ্য সম্পদ নয়, ব্রিটিশ ধনিক বণিকদের আকর্ষণের আর একটি লক্ষ্য ছিল এখানকার খনিজ সম্পদের দিকে। তারা অনুমান করতে পেরেছিলো যে, ভবিষ্যতে এখানকার মাটি থেকে বহু মূল্যবান খনিজ-সম্পদ আহরণ করা যাবে। অতএব ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক, এই গারো পাহাড় অঞ্চলকে তাদের হস্তগত করতেই হবে।
এই উদ্দেশ্যে প্রিভী কাউন্সিলে হার মানবার কিছুকাল পরে ১৮৬৯ সালে ‘গারো পাহাড় এ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হলো। আর সেই এ্যাক্টের জোরে সমস্ত গারো পাহাড় অঞ্চল রাতারাতি বৃটিশ ভারতের সরকারের অধিকারভুক্ত হয়ে গেল এবং এই অঞ্চল সরকারের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে শাসিত হতে লাগল।
এইভাবে ‘গারো পাহাড় এ্যাক্ট’-এর বদৌলতে এই অমূল্য সম্পদ জমিদারদেরও হাতছাড়া হয়ে গেল। হাতী-খেদার ব্যবসাটা ইতিমধ্যে লোপ হয়ে এসেছিল। এতো বড় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হবে কি দিয়ে! এবার জমিদারের নজর পড়ল এই অঞ্চলের আদিবাসী প্রজাদের দিকে। তাঁরা স্থির করলেন, অন্যান্য জায়গায় যেভাবে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয়ে থাকে, এখানেও সে ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু দিনের মধ্যেই এই নতুন বিধান জারি হয়ে গেল। তবে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে এই নতুন ব্যবস্থার একটু স্বাতন্ত্র্য ছিল। এখানে পরিবারগতভাবে খাজনা ধার্য না করে এক একটা গ্রামের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা নির্ধারিত করে দেওয়া হলো। গ্রামের মোড়লের উপর খাজনা আদায়ের ভার দেওয়া হলো। তিনি গ্রামের পরিবারের মধ্যে মোট খাজনার অংশ ধার্য করবেন এবং যথাসময়ে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে জমা দেবেন।
এই নতুন ব্যবস্থায় ক্ষেপে উঠল প্রজারা। যে মাটি তারা পুরুষের পর পুরুষ ধরে অবাধে ভোগ করে আসছে তার জন্য খাজনা দিতে হবে! মালিকপক্ষ এইভাবে তাদের এতোকালের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করবে! দেখতে দেখতে প্রজাদের এই অসন্তোষ দাবানলের মত সমগ্র অঞ্চলজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, এই বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র অভ্যুত্থানের রূপ নিল। বিভিন্ন কারণে এই ব্যাপারে হাজং কৃষকরাই সংগ্রামী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সেইজন্যই এই বিদ্রোহ ‘হাজং বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। শেষ পর্যন্ত জমিদার সরকারের সহায়তায় হাজং কৃষকদের এই বিদ্রোহকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।
দেশে দেশে যুগে যুগে কৃষকদের মধ্যে এমন কত বিদ্রোহ উঠেছে আর ভেঙ্গে পড়েছে, তার কতটুকু খবরই বা আমরা রাখি! যাদের মেহনতে সমাজের রথটা চলেছে, তাদের জীবন-সংগ্রামের কথা আমাদের ইতিহাসে খুব কমই স্থান পেয়ে থাকে। সেজন্যই সেদিনকার হাজং কৃষকদের সেই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৯০ সালে। শোনা যায়, চার অঞ্চল থেকে চারজন হাজং কৃষক নেতা এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব করেছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন গোঁড়া চাঁদ। এ যুগের হাজং কৃষকরা সেই বিদ্রোহের স্মৃতি এখনও হারিয়ে ফেলে নি। এই বিদ্রোহের জন্য তারা মনে মনে গৌরববোধ করে। ১৯৩৮-৩৯ সালে এখানকার হাজং কৃষকদের মধ্যে যে বিরাট অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের সচেতন ও সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছে। তারই পটভূমিকা হিসেবে গত শতাব্দীর সেই হাজং বিদ্রোহের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
সুসঙ দুর্গাপুর, চলতি কথায় দুর্গাপুর। সুসঙ দুর্গাপুরের রাজবংশ বা জমিদার বংশ একসময়ে প্রবল প্রতাপশালী ছিলো। কিন্তু যুগধর্ম অনুসারে তাদের প্রতাপের শিখাটা কমতে কমতে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল।
তবু হাতী মরলেও লাখ টাকা। আর হাতীটা তো সত্য সত্যই মরে নি, তার দাপট তখনও শেষ হয়ে যায় নি। ভাগে ভাগে বিভক্ত
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments