স্বদেশী-আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী-আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এই সময় থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এক নূতন রূপ-সংগ্রামী রূপ গ্রহণ করল। নানা কারণে সারা ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সচেতনতা লাভ করেছিল। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে সমগ্র ভারতকে এক নূতন পথের নিশানা দিল। এই আন্দোলন প্রধানতঃ বাংলা প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বটে কিন্তু তার প্রবাহ দেখতে দেখতে সারা দেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই নূতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মূলে যার দায়িত্ব সর্বাধিক তিনি হচ্ছেন ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কার্জন। অবশ্য দুদিন আগে হোক বা পরে হোক ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যেত না। বাংলাদেশকে দুভাগে ভাগ করার চক্রান্তের ফলে লর্ড কার্জন যে সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে দ্রুতায়িত করে এনেছিলেন সেই বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে এটাকে তার একটা বিশেষ অবদান বলা চলে।

ব্রিটিশ রাজনীতির ধুরন্ধরদের ইঙ্গিতে ও সহায়তায় ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ জন্মলাভ করল। ব্রিটিশ সরকারের পরম বংশবদ অভিজাত মহলের মুসলমান নেতাদের নিয়ে মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল। একথা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ফলে রাজনৈতিকভাবে অচেতন ভারতের শিক্ষিত মুসলমান সমাজ এই নবগঠিত মুসলিম লীগকে সাগ্রহ অভিনন্দন জানিয়েছিল।

১৯০৪ সালে বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি নূতন প্রদেশ গঠনের এই পরিকল্পনা শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহের সঞ্চার করেছিল। এতকাল সরকারী চাকুরী লাভের সুযোগসুবিধা হিন্দুদেরই একচেটিয়া ছিল। বাংলার শিক্ষিত মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিল যে সংখ্যাধিক্য মুসলমানদের বাসভূমি এই নবগঠিত প্রদেশে তারা এই বিশেষ বিষয়ে অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার লাভ করবে। এই সমস্ত শিক্ষিত মুসলমানদের প্রচারের ফলে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে বঙ্গভঙ্গের অনুকূল মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ সরকার সেদিন তার ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ নীতির সাহায্যে বাংলা তথা ভারতের মুসলমান সমাজকে তার ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানরা সেদিন প্রত্যক্ষভাবে এই স্বদেশী আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করেছিল, কারো মনে যদি এই ধারণা থেকে থাকে, তাহলে তাদের কিছুটা ভুল বোঝা হবে। এই আন্দোলনের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সরকার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ মহলের উস্কানীদাতাদের প্ররোচনার ফলে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও হাঙ্গামা ঘটেছিল একথা সত্য, কিন্তু তাই দিয়ে সমস্ত মুসলমান সমাজকে বিচার করা চলে না। অবশ্য মুসলমানদের বেশী সংখ্যক লোকই এই স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেনি। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাঁরা আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করত, আন্দোলনের প্রভাব তাদের উপরও এসে পড়েছিল, কিন্তু তাদের নিজেদের নেতাদের বাধা ও নিষেধের ফলে তারা বেশী এগিয়ে যেতে পারেনি। এ বিষয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে।

১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। সে সময়কার সংবাদপত্র থেকে একথা জানা যায় যে বঙ্গভঙ্গের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ, বরিশাল, ও শ্রীরামপুরের বিভিন্ন মসজিদে প্রার্থনা করা হয়েছিল। এরপর থেকে সারা প্রদেশময় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে লাগল। এই উপলক্ষে কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, মাদারীপুর, বানরিপাড়া, খানখানপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি স্থানে অনুষ্ঠিত কোনো কোনো সভায় স্থানীয় মুসলমান ভদ্রলোকেরা, এমনকি মুসলমান জমিদারেরা পর্যন্ত সভাপতির আসন গ্রহণ করতেন। এই সব ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে পুলিশ রিপোর্টে একটু তিক্ততার সঙ্গেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, “এই সমস্ত সভার হিন্দু সংগঠকরা যোগ্যতা থাক আর নাই থাক, যে কোনো মুসলমানকে এনে সভাপতির আসনে বসিয়ে দিত।” যারা নিয়মিতভাবে এই সমস্ত স্বদেশী সভায় বক্তৃতা দিতেন, তাদের মধ্যে মুসলমান বক্তাদের সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য ছিল না।

স্বদেশী আন্দোলনের এই জোয়ারের সময় বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলিকাতায় এবং মফঃস্বল জেলাগুলিতে বহু সভা সমিতি অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছিল। এই সমস্ত সভায় যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান বক্তারা বক্তৃতা দিতেন। সরকার পক্ষের রিপোর্টে এই সমস্ত মুসলমান নেতা ও কর্মীদের হিন্দু আন্দোলনকারীদের হাতের পুতুল বা দালাল বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তাদের এই মিথ্যা প্রচারণা প্রকৃত ইতিহাসকে চাপা দিতে পারেনি, যে সমস্ত বিশিষ্ট মুসলমান বক্তা সে সময় এই সমস্ত সভায় বক্তৃতা দিতেন তারা সকলেই শ্রদ্ধার পাত্র। সরকার পক্ষ যতই চেষ্টা করুক না কেন তাদের হিন্দুদের দালাল বলে প্রতিপন্ন করতে পারেনি। সেই সমস্ত বক্তাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মুসলমান নেতাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ব্যারিস্টার আবদুল রসুল, মৌলবী আবদুল কাশীম, দেদার বক্স, দীন মোহম্মদ, লিয়াকত হোসেন, ইসমাইল সিরাজী, আবদুল হালিম গজনবী প্রমূখ।

এই আন্দোলনের সামনের সারিতে যারা ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল তাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন। তাকে এবং তার সহকর্মী অন্যান্য মুসলমান নেতা ও কর্মীদের এ জন্য বিরুদ্ধবাদীদের নির্যাতনের পাত্র হতে হয়েছে, এমনকি তাদের শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আদর্শনিষ্ঠ অদম্য মানুষগুলিকে দমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯০৬ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে পুলিশের লাঠির ঘায়ে শহরের রাজপথ রক্তরঞ্জিত হয়েছিল। আবদুর রসুল সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। তিনি পুলিশের আক্রমণের হাত থেকে অব্যাহতি পাননি। সরকারী এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য ১৪ই মে তারিখে কলিকাতার কলেজ স্কোয়ারে চার হাজার মুসলমান সমবেত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বিভেদ পন্থী মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে ব্যাপক প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও সেই সময় ‘দি বেঙ্গলী’ পত্রিকায় ২৫টি রাখীবন্ধন অনুষ্ঠানের সভার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, এই সভাগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান যোগদান করেছিলেন।

এই স্বদেশী আন্দোলনে সারা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করেছিল বরিশাল। বরিশালের মুকুটহীন রাজা সর্বজনপ্রিয় অশ্বিনী কুমার দত্ত এবং তাঁর সহকর্মীরা বেশ কিছুকাল আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশী মন্ত্র প্রচারের কাজ চালিয়ে আসছিলেন। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, এই বিষয়ে সারা ভারতে তিনিই প্রথম পথদ্রষ্টা। ১৯০৮ সালে বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত বরিশাল জেলায় মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষে সুসংগঠিত সেবাকার্যের মধ্য দিয়ে অশ্বিনী কুমার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সর্বসাধারণের মধ্যে এক অতুলনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার বলে তার স্বদেশী আন্দোলনের আহ্বান বরিশালের শহর ও গ্রামঞ্চলের ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছেছিল। তাঁর কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে মফিজউদ্দিন বয়াতী জারিগানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ করে তুলেছিল। বরিশালের হিন্দু মুসলমানের এই মিলিত প্রতিরোধের ফলে সেদিনকার বরিশাল ব্রিটিশ সরকারের কাছে দুর্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের পরম অনুগত ঢাকার নবার সলিমুল্লাহ নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানী দিয়ে বরিশালের মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি, কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

স্বদেশী আন্দোলনের সর্বক্ষেত্রেই মুসলমানদের মধ্যে কিছু না কিছু সহযোগিতার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। স্বদেশী ব্যবসার ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের আবদুল হালিম গজনবী এবং বগুড়ার নবাবের উদ্যোগে ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল কোম্পানী’ ও ‘বেঙ্গল হোসিয়ারী কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণা থেকেই চট্টগ্রামের মুসলমান ব্যবসায়ীরা ‘দি বেঙ্গল স্টীম কোম্পানী’ নামে একটি স্টীমার কোম্পানী দাঁড় করিয়েছিলেন। যে সমস্ত স্বদেশী নেতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন আবদুর রসুল ছিলেন তাদের অন্যতম। ৯২জন সভ্য নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন’এর মধ্যে ৭৬জন সভ্য ছিলেন মুসলমান। ব্রাহ্ম নেতৃত্বে পরিচালিত অ্যান্টি-সারকুলার সোসাইটিতে মুসলমান কর্মীরা সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন। ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত ইস্ট ইনডিয়ান রেলওয়ের ধর্মঘটের সময় আবুল হোসেন ও লিয়াকত হোসেন প্রচারকার্যে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯০৭ সালে ‘ইস্টার্ণ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে’র ৬ জন ড্রাইভার তাদের কাজ থেকে

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice