মওলানা আবুল কালাম আজাদ

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সমস্ত জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন, তাদের প্রথম সারির মধ্যে মওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই নামটি সবচেয়ে সুপরিচিত। মওলানা আজাদ তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে যে কথাগুলি লিখে গেছেন, তা থেকেই আমরা ভারতের এই প্রতিভাশালী, সদা সক্রিয়, স্থিরবুদ্ধি ও দৃঢ়চিত্ত চরিত্রটির পরিচয় পেয়েছি।

মওলানা আজাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন বাবরের ভারত অভিযানের সময় হিরাট থেকে এদেশে এসেছিলেন। মোগল রাজত্বের যুগে এই বংশের বহু কৃতি পুরুষ ধর্মীয় ক্ষেত্রে এবং সরকারী প্রশাসন কার্যে বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করে এসেছেন। মওলানা আজাদের পিতামহের যখন মৃত্যু হয় মওলানা আজাদের পিতা মওলানা খাইরুদ্দিন তখন নিতান্ত শিশু। সেই সময় থেকে তিনি তাঁর মাতামহ মওলানা মুনাওয়ারুদ্দিনের গৃহে প্রতিপালিত হয়ে আসছিলেন।

মওলানা মুনাওয়ারুদ্দিন দেশত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে বসবাস করবেন বলে সংকল্প করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি যখন ভুপালে গিয়ে পৌঁছেছেন, ঠিক সেই সময় ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। ফলে তাঁকে বাধ্য হয়ে তখনকার মত যাত্রা স্থগিত রাখতে হলো। কিন্তু মক্কায় জিয়ারত করবার ও মক্কাবাসী হবার এই সংকল্প পূর্ণ করবার সুযোগ তিনি পাননি। বিদ্রোহ শুরু হবার দুবছর বাদে তিনি বোম্বাইতে গিয়েছিলেন, সেইখানেই তাঁর জীবনের অবসান ঘটল।

মওলানা আজাদের পিতা মওলানা খাইরুদ্দিনের বয়স তখন মাত্র ২৫। সেই সময়েই তিনি তাঁর মাতামহের সংকল্পিত পন্থা অনুসরণ করে দেশ ছেড়ে মক্কায় চলে গেলেন এবং সেইখানে বাড়িঘর তৈরী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। তিনি মদিনার বিখ্যাত আলেম শেখ মহম্মদ জাহের ওয়াত্রির মেয়েকে বিয়ে করেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ এই আরব কন্যার একমাত্র সন্তান। ভারত মওলানা আজাদের জন্মভূমি নয়। কিন্তু তাহলেও এই দেশই তাঁর স্বদেশ, এই দেশই তাঁর কর্মভূমি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই দেশ এবং এই দেশের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন।

মওলানা আজাদের মাতামহ শেখ মহম্মদ জাহের ওয়াত্রি তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য সমগ্র আরব জগতে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা মওলানা খাইরুদ্দিনও তাঁর পরবর্তী জীবনে আলেম হিসাবে পরিচিত লাভ করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর আরবী ভাষায় লিখিত দশখণ্ডের গ্রন্থটি মিশরে প্রকাশিত হবার পর তাঁর খ্যাতি সারা ইসলামী জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

দুটি একটি ঘটনা কিভাবে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, মওলানা আজাদের জীবনে আমরা তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। ঘটনাগুলি যেভাবে এগিয়ে চলেছিল, তাতে ভারত যে একদিন মওলানা আজাদের স্বদেশ ও কর্মভূমিতে পরিণত হবে এমন একটা সম্ভাবনার কথা কারও মনেই জাগতে পারত না। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনা তাঁর জীবন ধারার গতি সম্পূর্ণভাবে ঘুরিয়ে দিল। একটি দুর্ঘটনার ফলে পা ভেঙ্গে যাওয়ায় তাঁর পিতা মওলানা খাইরুদ্দিন অচল হয়ে পড়েছিলেন। তখনকার দিনে আরব জগতে প্রচলিত চিকিৎসার সাহায্য একে সারিয়ে তোলার কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা ছিল না। সেই সময় অস্ত্রোপাচারের ক্ষেত্রে কলিকাতার শল্য-চিকিৎসকদের খুবই নাম-ডাক। খাইরুদ্দিন চিকিৎসার জন্য কলিকাতায় যাওয়া মনস্থ করলেন। মানুষের জীবন ও ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি। খাইরুদ্দিন সপরিবারে কলিকাতায় এলেন। এখানকার চিকিৎসার ফলে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন, কিন্তু আরব ভূমিতে ফিরে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না। কলিকাতার গুণমুদ্ধ ভক্তদের একান্ত অনুরোধ তাঁকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে এখানে থেকে যেতে হলো। এর ফলে মওলানা আজাদ তাঁর শৈশবকাল থেকে এখানকার জল-হাওয়ায় এবং এখানকার সামাজিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেন। পরবর্তীকালে সারা ভারত তার কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু একথা আমরা গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করি যে, তিনি শুধু ভারতীয় নন, বাঙালিও বটে। মওলানা আজাদ ১৮৮৮ সালে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯০ সালে তাঁদের স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসতে হলো। তখন তিনি মাত্র দুই বছরের শিশু।

মওলানা খাইরুদ্দিন ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক মতামতের দিক দিয়ে প্রাচীনপন্থী ছিলেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কাজেই মওলানা আজাদকে আধুনিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল। তখনকার দিনের ভারতের মুসলমান ছেলেদের শিক্ষাদানের জন্য যে রীতি প্রচলিত ছিল, মওলানা আজাদকেও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে হলো। মুসলমান ছেলেদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি ছিল মোটামুটি এই, প্রথমেই তাদের ফারসি এবং আরবী ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। আরবী ভাষায় কিছুটা ব্যুৎপত্তি লাভ করলে পর তাদের আরবীয় মাধ্যমে প্রাচীন আরব জগতের দর্শন, জ্যামিতি, অঙ্কশাস্ত্র ও বীজগণিত সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো। অবশ্য ধর্মীয় শিক্ষা এই পাঠ্যসূচীর অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। সেটা ছিল সকলের পক্ষে বাধ্যতামূলক।

তাঁর পিতা তখনকার দিনের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী শিক্ষালাভের জন্য তাঁকে কোনো মাদ্রাসায় পাঠাননি। তখনকার দিনে মুসলমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে কলিকাতার মাদ্রাসার খ্যাতি ছিল বটে, কিন্তু এখানকার মাদ্রাসাগুলির মান সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা পোষণ করতেন না। সেই শিশু বয়সেই তাঁর ছেলের প্রতিভার স্ফূরণ তিনি লক্ষ করেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষাদানের দায়িত্বটা তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজের হাতে নিয়েছিলেন। পরে তাঁকে সুশিক্ষিত করে তুলবার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন ব্যক্তিদের গৃহ শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।

তখনকার দিনে ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষার্থীর কুড়ি থেকে পঁচিশ বৎসর বয়সে তাদের শিক্ষাসূচী সমাপ্ত করতে পারত। সেই সময়ের মধ্যেই তাদের অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিতে হত। মওলানা আজাদ মাত্র ষোলো বছর বয়সে যোগ্যতার সঙ্গে এই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার গণ্ডি পার হয়ে এলেন। তাঁর যোগ্যতা পরীক্ষার জন্য তাঁর পিতা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পনের জন তরুণ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে দিয়েছিলেন।

এই সময় মওলানা আজাদ স্যার সৈয়দ আহমদের লেখার সংস্পর্শে আসেন এবং আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সপক্ষে স্যার সৈয়দ আহমদের মতামত তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে এই সত্যটা তাঁর কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে শিক্ষা লাভ না করলে এ যুগে সত্যিকারের শিক্ষিত মন গড়ে উঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। এই বিষয়ে তাঁর পিতার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। চিন্তায় ও আচরণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া মুসলমান, বিশেষ করে ওয়াহবী সম্প্রদায়ের মতামতের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র অসহিষ্ণুতা ও বিরূপ মনোভাব মওলানা আজাদের প্রথম তারুণ্যের গ্রহণশীল মনকে গভীরভাবে আঘাত করত। পিতা পুত্রের কারো পক্ষেই পরস্পরের মধ্যে এই দুস্তর ব্যবধান কাটিয়ে উঠা কোনোদিনই সম্ভব হয়নি। বরঞ্চ পিতার এই গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতার প্রতিক্রিয়া তার তাজা ও সৃজনশীল মনকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল।

আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সংযোগ সাধনের জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কাজে নেমে গেলেন। সত্য কথা বলতে কি কারো সাহায্যে ছাড়া একমাত্র নিজের উদ্যোগে তিনি ইংরেজী ভাষা শিখতে শুরু করলেন। মৌলবী মহম্মদ ইউসুফ জাফ্রির সাহায্যে তিনি শুধু ইংরেজী অক্ষর জ্ঞানটুকু লাভ করেছিলেন। পরে ইংরেজী ভাষায় তিনি যেটুকু অধিকার লাভ করেছিলেন সেজন্য এই ষোল বছরের ছেলেটিকে একমাত্র নিজের চেষ্টার উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তখনকার দিনের সুপ্রচলিত প্যারীচাঁদ সরকারের ‘ফার্স্ট বুক’ দিয়ে তাঁর ইংরেজী শেখা শুরু হলো। তারপর ইংরেজী ভাষার এই জ্ঞানটুুকুকে পুজিঁ করে এই দুঃসাহসী ছেলে ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাইবেল অধ্যয়নে মনোনিবেশ করল। এই বাইবেল অধ্যয়নের ব্যাপারে তিনি নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। ফরাসী উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় অনূদিত তিনটি বাইবেলকে পাশাপাশি রেখে তিনি ইংরেজী বাইবেলকে আয়ত্ব করে চলেছিলেন। এছাড়া তিনি ইংরেজী অভিধানের সাহায্য নিয়ে ইংরেজী সংবাদপত্র পাঠ করতেন। এইভাবেই তিনি তাঁর নিজের উদ্ভাবিত পন্থায় ইংরেজী

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice