খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন
খিলাফত সমস্যা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে এক ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে তুলেছিল। যুদ্ধপূর্বে সংঘটিত ঘটনাবলী দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং নেতৃবৃন্দের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে চলেছিল। ভারতের বিপ্লবীরা এই যুদ্ধের সংকটের সুযোগে ব্রিটিশের শক্র জার্মানীর সহায়তা নিয়ে ভারতে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সৃষ্টি করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, এ কথা ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
শুধু বিপ্লবীরাই নয়, যুদ্ধকালীন ও যুুদ্ধপরবর্তী ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে সারা দেশের মানুষের রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষার দ্রুত রূপান্তর চলেছিল। ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯১৬ সাল বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। লক্ষ্ণৌর যুক্ত সম্মেলনে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে জিন্নাহ মহম্মদ আলী, আনসারী ও মাহমুদাবাদের রাজা এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অম্বিকাচরণ মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল নেহরু ও তিলক আলোচনায় যোগদান করেছিলেন। হোমরুল, দায়িত্বশীল সরকার গঠন, গঠনতন্ত্রের সংশোধন ইত্যাদি তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এই আদর্শগুলিকে সামনে রেখেই তারা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
এই চুক্তির মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী উভয় মতের নেতারাই ছিলেন এবং তাদের এই যুক্ত উদ্যোগ এক মিলিত আন্দোলনের সূচনা করেছিল।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সেই ঘনঘটা ও ঝটিকাপূর্ণ পরিবেশ এই কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করে তোলা সম্ভব হয়নি। তুরস্ক যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জার্মানীর সঙ্গে যোগ দিল, ভারতের মুসলমানরা তখন এক উভয় সংকটের মধ্যে পড়ল। সারা ভারতের হিন্দু মুসলমান নেতারা এই যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করবে বলে প্রস্তাব নিয়েছিল। শুধু প্রস্তাব নেওয়া নয়, কার্যত তারা ইংরেজদের সাহায্যে অর্থবল ও ধনবল জুগিয়ে চলেছিল। কিন্তু তুরস্ক এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে গভীর দ্বিধা ও সংশয়ের ভাব দেখা দিল—মুসলমান হয়ে তারা তুরস্কের মুসলমান ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। বিশেষ করে তুরস্কের খলিফা সারা মুসলিম জগতের ধর্মীয় নেতা, এই প্রশ্নটা ভারতের মুসলমানদের মনে দারুণ বিক্ষোভের সৃষ্টি করে চলেছিল।
ভারতের মুসলমানদের মনের এই দ্বিধা ও সংশয় সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার অচেতন ছিলেন না। কাজেই তারা সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিকারের চেষ্টায় এগিয়ে এলেন। মুসলমানরা যাতে রাজভক্তির পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে বিরুদ্ধে চলে না যায়, সেজন্য ভারতের ব্রিটিশ অফিসাররা এখানকার উলেমাদের কাছে এই প্রতিশ্রুতি দিলেন যে আরব ও মেসোপোটেমিয়ার মুসলমানদের যে সকল ধর্মস্থান আছে, যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক না কেনো, সে গুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং তাদের উপর কোনো রকম হামলা করা হবে না। মিত্র পক্ষের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিও এ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দান করে ঘোষণা দিল। লয়েড জর্জ তুরস্কের মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষা সম্পর্কে প্রতিশ্রতি দিলেন। এই আশ্বাস পেয়েই ভারতের মুসলমান সৈন্যরা মেসোপোটেমিয়ায় ও অন্যান্য অঞ্চলে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা আরবে তুরস্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের প্ররোচনায় মক্কার শরীফ হোসেন তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুর্কীদের মেসোপোটেমিয়া থেকে বিতাড়িত করল।
এদিকে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হতে লাগল। সরকারী নির্দেশে মওলানা আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত ‘আল হেলাল’ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং মওলানা আজাদকে করাচীতে অন্তরীণ করে রাখা হলো। যতদিন যুদ্ধ চলেছিল ততদিন তাঁকে সেখানেই আটক থাকতে হয়েছিল। মওলানা মহম্মদ আলী তুরস্কের জার্মানীর পক্ষে যোগ দেওয়াকে সমর্থন করে তাঁর ‘কমরেড পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই অপরাধে সরকারী আদেশে ‘কমরেড’ পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে গেল এবং তাঁকে ও তাঁর ভাই শওকত আলীকে অন্তরীণ করে রাখা হলো। যারা হোমরুলের দাবী নিয়ে আন্দোলন করছিলেন তারাও সরকারী হামলার হাত থেকে অব্যাহতি পেলেন না। হোমরুল আন্দোলনের নেত্রী এ্যানি বেশান্ত ও তাঁর দুজন সহকর্মীকেও এই উপলক্ষে অন্তরীণ করা হয়েছিল।
১৯১৮ সালে যুদ্ধে জার্মানী ও তুরস্কের চুড়ান্ত পরাজয় ঘটল। ফলে বিজয়ী পক্ষের বিধান অনুযায়ী সমগ্র আরব সাম্রাজ্য তুরস্কের হাতছাড়া হয়ে গেল, এমন কি সেখানকার ধর্মস্থানগুলির উপরেও তার কোনো অধিকার রইল না।
এই বিষয়ে ইংল্যাণ্ড চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছিল। লয়েড জর্জ তাঁর ১৯১৮ সালের ৫ই জানুয়ারী প্রদত্ত এক বক্তৃতায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, এই যুদ্ধে তুরস্ককে তার রাজধানী অথবা তার এশিয়া মাইনরের সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি ও থ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো অভিপ্রায় তাদের নেই। কেননা এই অঞ্চলের লোকেরা তুর্কীদের স্বজাতি। কিন্তু ইংরেজদেরই ইঙ্গিতে উৎসাহিত হয়ে গ্রীস এশিয়া মাইনরে স্মার্না অধিকার করে নিল এবং এড্রিয়ানোপোলে প্রবেশ করে এজিয়ানস্ সাগরের দ্বীপগুলিকে গ্রাস করার জন্য সমুদ্র-উপকূলে ছড়িয়ে পড়ল।
এই সমস্ত ঘটনা, বিশেষ করে তুরস্কের খিলাফতের পতনের ফলে ভারতের মুসলমানদের মনে দারুণ উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এই সমস্যার প্রতিকারের জন্য ১৯১৯ সালে ভারতের বিশিষ্ট মুসলমান নেতাদের নিয়ে খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। বোম্বাইয়ের শেঠ সোহানী এর সভাপতি এবং অন্তরীণ-বাস থেকে সদ্যমুক্ত শওকত আলী এর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে ২৩ শে ডিসেম্বর দিল্লীতে প্রথম খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধীজী, মতিলাল নেহরু ও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে সভাপতি ছিলেন মওলবী ফজলুল হক। দ্বিতীয় দিন গান্ধীজীকে সভাপতির আসনে বসানো হয়েছিল। গান্ধীজী সেদিন তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন যে, এই সমস্যার প্রতিকার করতে হলে মুসলমানদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসহযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
অতঃপর এই সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য অমৃতসরে কংগ্রেস ও খিলাফত কমিটি একত্রে মিলিত হয় এবং পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা চলে। খিলাফত সম্মেলন ভারতের বড়লাট ও ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য একটি ডেপুটেশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
১৯২০ সালের ২০ শে জানুয়ারী তারিখে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত খিলাফত কমিটির এক সভায় গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের এক কর্মসূচী প্রদান করেন। কয়েকদিন পরে মীরাটে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে এই কর্মসূচী সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারী তারিখে মওলানা আবুল কালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং খিলাফত দিবস উদ্যাপনের জন্য একটি দিনটি ধার্য করা হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে সারা দেশে এ সম্পর্কে আরও অনেকগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বড়লাট ও ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর নিকট ডেপুটেশন প্রেরণ নিষ্ফল বলে প্রতিপন্ন হলো। তখন খিলাফত সম্মেলনের পক্ষ থেকে সরকারকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, তাদের দাবী পূর্ণ করা না হলে ১লা আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে।
কিন্তু এই আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে হলে খিলাফত কমিটি ও কংগ্রেসকে যুক্তভাবে আন্দোলনে নামা প্রয়োজন। ১৯২০ সালের ২০শে মে এলাহাবাদে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হলো। অতঃপর এই উদ্দেশ্যে ৮ই সেপ্টেম্বর কলিকাতায় কংগ্রেসের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন লালা লাজপৎ রায়। এই সম্মেলনেও সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, অবশ্য স্বরাজ লাভের উদ্দেশ্যটাকে এই প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল।
১৯২১ সালের জুলাই মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম চারটি ছিল তুরস্ক ও মুসলিম জগৎ সম্পর্কিত। শেষ ও পঞ্চম বিষয়টি ছিল ভারতের স্বাধীন রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের সংকল্প।
রাউলাট এ্যাক্ট
খিলাফত সমস্যার পাশাপাশি আরো একটি সমস্যা হিন্দু মুসলমান নির্বিচারে সকল ভারতবাসীর মনে দারুণ বিক্ষোভের সৃষ্টি করে চলেছিল। কুখ্যাত রাউলাট এ্যাক্ট এই বিক্ষোভের মূল কারণ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারত এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। এদেশের লোক এ যুদ্ধে ধনবল
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments