হযরত মোহানী

তাঁর আসল নাম ছিল সৈয়দ ফজলুল হাসান। কিন্তু এই নাম বললে কেউ তাকে চিনবেনা। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি হজরত মোহানী নামেই সুপরিচিত। তিনি ১৮৭৮ সালে উত্তর প্রদেশের উন্নাউ জেলার ‘মোহান’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কিশোর বয়স থেকে তিনি ‘হযরত মোহানী’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। সেই নামে আজও তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

উন্নত মেধার ছাত্র হিসাবে তিনি তার শিক্ষকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি সরকারী বৃত্তি লাভ করে আলীগড় কলেজে এসে ভর্তি হলেন। এখানে অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তার রচনার গুণে এবং একজন সংস্কৃতিসেবী হিসাবে সকলেরই মন জয় করে নিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি যে একজন উচ্চ শ্রেণীর লেখক বলে পরিচিত হবেন, এ বিষয়ে কারুর মনে কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু তরুণ হযরত মোহানীর মূল চিন্তাধারা কোন আদর্শকে লক্ষ্য করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তাঁর অত্যন্ত পরিচিত যারা তাঁরাও তা কল্পনা করতে পারেনি। সকলের দৃষ্টির অলক্ষ্যে মধ্যরাত্রির গোপন আশ্রয়ে তিনি শ্র্রীঅরবিন্দ ও বাল গঙ্গাধর তিলকের রাজনৈতিক সাহিত্যের চর্চায় ডুবে থাকতেন। সে সময় এটাই তার প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাড়িয়েছিল। এত গোপনীয়তা কেন? তার কারণ আলীগড় কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতি বা যে কোনও ধরনের প্রগতিশীল রাজনীতিকে বিষ-দৃষ্টিতে দেখতেন। সেই কলেজের এমন একজন জনপ্রিয় ছাত্র যে রাজদ্রোহাতক সাহিত্যের মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকতে পারে, এমন কথা কেউ ভাবতেও পারত না।

একটা বিশেষ ঘটনার মধ্য দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অতি প্রিয়পাত্র হযরত মোহানীর প্রকৃত স্বরূপটা একদিন প্রকাশিত হয়ে পড়ল। কলেজের স্টুডেণ্টস ইউনিয়নের উদ্যোগে একটি উর্দু কবিতার মোশায়রার আয়োজন করা হয়েছিল। হজরত মোহানী-ই ছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা। এই মোশায়রা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কলেজের অধ্যক্ষ থিয়োডোর মরিসন এর কাছে এই খবর গিয়ে পৌঁছুল যে, যাঁরা স্ব-রচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নাকি শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছিলেন।

এই ব্যাপারে কৈফিয়ৎ দেবার জন্য অধ্যক্ষের কাছে মোশায়রার মুল উদ্যোক্তা হজরত মোহানীর ডাক পড়ল। এই শালীনতা ভঙ্গের প্রশ্ন নিয়ে অধ্যক্ষ ও হজরত মোহানীর মধ্যে এক তিক্ত বাদানুবাদ ঘটে গেল। এই প্রসঙ্গে হজরত মোহানী সেদিন বলেছিলেন, ‘‘স্যার, আমাদের এই কবিরা মানবতার মহান আদর্শ উদ্বুদ্ধ। আপনাদের সমাজে এঁরা শালীনতা ভঙ্গের জন্য নিন্দিত হবেন, এটা বিচিত্র কিছু নয়। মুখের উপর এই জবাব পেয়ে অধ্যক্ষের ক্রোধের সীমা রইল না। তিনি এই ব্যাপারে উপযুক্ত কৈফিয়ৎ দানের জন্য তখনই কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের এক সভা ডাকালেন। এই সভার সিদ্ধান্ত কি হবে তা আগে থেকেই জানা ছিল। ১৯০৩ সাল আলীগড় কলেজের পক্ষে একটি স্মরণীয় বৎসর। এই বছরই সর্বপ্রথম একজন ‘বিদ্রোহী’কে কলেজ থেকে বহিস্কৃত করা হয়েছিল।

এবার তার জীবনে এক নতুন অধ্যায় নেমে এলো। সে যুগে বি. এ. ডিগ্রীর যথেষ্ট মূল্য ছিল, কিন্তু এই ডিগ্রী তার কোনো বিশেষ কাজে এলো না। সে সময় আইন ব্যবসা ছিল অর্থোপার্জনের সর্বোৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু হজরত মোহানী সেই পথে না গিয়ে সাহিত্যের পথকে বেছে নিলেন এবং কংগ্রেসের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এর ফলে সারাজীবন ধরে তাঁকে দারিদ্র্যের বোঝা টেনে চলতে হয়েছে। এ সময় তিনি একটি উর্দু পত্রিকা পরিচালনা করতেন। কংগ্রেস কর্মী হিসাবে তিনি ১৯০৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রতিটি বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেস সম্মেলন গোখলের নরমপন্থী দল এবং তিলকের চরমপন্থী দলের সংঘর্ষের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তিলকের আদর্শে প্রভাবিত হজরত মোহানী চরমপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

ভারতীয় জনমতের মুখ চাপা দেবার উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে সরকার কর্তৃক কুখ্যাত ‘নিউজ পেপারস এ্যাক্ট’ জারি করা হয়েছিল। এই আইনের বলে হজরত মোহানী কর্তৃক পরিচালিত পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এক মামলা আনা হলো। এই মামলায় তিনি দুই বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। এইবারই তিনি প্রথম দেশসেবার পুরস্কার পেলেন। এই একই কারণে ভবিষ্যতে তাঁকে আরও পাঁচবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। হজরত মোহানী চিরদিনই সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে গেছেন। উনিশ শতকের কংগ্রেস উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ-শতকের প্রথম ভাগে কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ সাধনা ও আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা বজায় রেখে যাঁরা কংগ্রেসকে সাধারণ মানুষের মধ্যে টেনে নামিয়ে এনেছিলেন, হজরত মোহানী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর এই আপোসহীন আদর্শের জন্য কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যেও কারো কারো সঙ্গে তাঁর সংঘাত ঘটেছিল। সে সময় জিন্নাহ সাহেব কংগ্রেসের মধ্যে ছিলেন। তার সঙ্গে প্রবল মতবিরোধ ঘটেছিল। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিরোধিতার অবসান হয়নি।

কংগ্রেসের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিষয়ে তার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ সম্মেলনে তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সে যুগের পক্ষে এর একটা বৈপ্লবিক তাৎপর্য ছিল। গান্ধীজী এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। সে সময় কংগ্রেসের মধ্যে তাঁর অখণ্ড প্রভাব। তা সত্ত্বেও তার বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করতে হজরত মোহানী বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তার এই প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে পরাজিত হয়েছিল একথা সত্য, কিন্তু তা হলেও তার এই পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব ভবিষ্যতে দিক্ নিরূপণের ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছে।

হজরত মোহানী উত্তর প্রদেশের মুসলমান সমাজে স্বদেশী আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে কাজে নেমেছিলেন। এই অপরাধে বারবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। ফলে তিনি কোনোদিনই শান্তি ও সাফল্যের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতে পারেননি। দেশকে ভালোবসেছিলেন বলে তাঁকে দুঃখ ও অভাবের জীবনই বরণ করে নিতে হয়েছিল। এই কণ্টকময় পথে তার স্ত্রী নিশাত ফাতেমা ছিলেন তার উপযুক্ত জীবন-সঙ্গিণী। কঠিন দুঃসময়ের দিনেও তিনি সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে তার স্বামীকে অনুগমন করে চলতেন। সেই কারণেই হজরত মোহানীর মতো বেগম মোহানীও অনেকের শ্রদ্ধা এবং তার চেয়েও বেশী লোকের সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিশাত ফাতেমা স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পর্দার আবরণ ভেঙ্গে প্রকাশ্য রাজপথে বেড়িয়ে এসেছিলেন। সে যুগের সম্ভ্রান্ত মুসলমান মহিলাদের পক্ষে এটা একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। সমাজের ভ্রুকুটিকে তুচ্ছ করে তিনি সাহসের সঙ্গে এই পথে নেমে এসেছিলেন।

১৯২৮ সালে ‘নেহেরু রির্পোট’ নিয়ে আলোচনা করার জন্য কলকাতায় এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘চৌদ্দ পয়েন্ট’ সম্বলিত দাবী মেনে না নেওয়ার ফলে এই সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর প্রতিবাদে কংগ্রেসী মুসলমানদের একটি অংশ কংগ্রেস ছেড়ে চলে যান। হজরত মোহানীও তাদের সঙ্গে ছিলেন। এই ভাবে কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ হজরত মোহানী কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এ এক করুণ পরিণতি। তারপর দুটি দশক ধরে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার ফলে ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে বহু অঘটন ঘটে চলল। কিন্তু মুসলিম লীগ সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব অনুমোদনের চরম মুহূর্তে হজরত মোহানী তার বিদ্রোহের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সম্মেলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে জিন্নাহ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে তিনি এই হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন, ‘মি. জিন্নাহ আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনি একদল রাজনৈতিক স্বার্থানে¦ষীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছেন!’

তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি ভারতের গণপরিষদের (Constituent Assembly) সভ্য হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তিনি বিদ্রোহীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই গণপরিষদে ভারতীয় গঠনতন্ত্রের খসড়া রচিত হওয়ার পর তিনি তাতে স্বাক্ষর করতে রাজী হননি। কয়েকটি কারণে তিনি এই

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice