মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানী
মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানী ছিলেন পাঞ্জাবের লুধিয়ানার অধিবাসী। তাঁদের বংশে একটি দেশপ্রেমিক ঐতিহ্য ছিল, যেটা নিঃসন্দেহে তাঁর চরিত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখানে সেই পুরানো দিনের কাহিনীটির উল্লেখ করছি।
এই ঐতিহ্যের উৎস সন্ধানে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের যুগে। লুধিয়ানের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট পরিবারটি এই মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। পরিবারের প্রধান ছিলেন আবদুল কাদের। দিল্লীশ্বর বাহাদুর শাহ্ স্বাধীনতার ঘোষণার পর আবদুল কাদেরকে দিল্লীতে চলে আসার জন্য নির্দেশ পাঠালেন। সেই নির্দেশ পেয়ে আবদুল কাদের এবং তাঁর বীর ছেলেরা দিল্লীর পথে যাত্রা করলেন। কিন্তু সে পথ বড় বিপজ্জনক, পথে পথে ব্রিটিশ সৈন্যদের ঘাঁটি। আবদুল কাদেরের সশস্ত্র দল সেই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজধানী দিল্লী শহরে গিয়ে পৌঁছেছিলেন।
আজাদ দিল্লীর পতনের পর আবদুল কাদের ও তাঁর পরিবার কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়ে পাতিয়ালার অরণ্যে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। ব্রিটিশ সরকার বহু চেষ্টা করেও তাঁদের গ্রেফতার করতে পারলো না। পরে মহারাণী ভিক্টোরিয়া যখন ‘এমনেস্টি’ বা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন, আবদুল কাদেরের পরিবার তখন লুধিয়ানায় ফিরে এলো। কিন্তু আবদুল কাদের তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ পান নি। পথেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল।
আবুদল কাদেরের ছেলেরা দেশে ফিরে এসে তাঁদের পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি ধর্মীয় শিক্ষাদানের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। ১৮৮৫ সালে যখন ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম হলো, আবদুল কাদেরের ছেলেরা তাকে স্বাগত জানালেন। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের প্ররোচনায় তাদের একান্ত বশংবদ আলীগড় কলেজের কর্তৃপক্ষ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। আবদুল কাদেরের ছেলে শাহ মহম্মদ স্যার সৈয়দ আহমদের এই প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দু মুসলমানের মিলনের আহ্বান জানিয়ে এক ফতোয়া জারি করলেন। এই ফতোয়ার নীচে এক হাজার উলেমার স্বাক্ষর ছিল। এই ফতোয়ার শিরোনাম ছিল ‘‘নসরত আল আব্বার” অর্থাৎ কল্যাণের বিজয়। ১৮৮৮ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে হাজার হাজার ফতোয়া ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এরপর থেকেই লুধিয়ানা উদারপন্থী জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই আদর্শ প্রচারের জন্য প্রথমে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং পরে ‘অবজারভার’ নামে একটি ইংরেজী পত্রিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তাঁদের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তাঁরা প্রথম থেকেই সরকারী কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ‘অবজারভার’ পত্রিকটি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কোনোমতে টিকে ছিল।
এই শাহ মহম্মদের পুত্র মওলানা মহম্মদ জাকারিয়া এবং তাঁরই পুত্র মওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি ১৮৯২ সালে লুধিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খিলাফত সমস্যা নিয়ে সারা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। লুধিয়ানার আলেমরাও এই ব্যাপারে সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। গান্ধীজী এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। শুধু সমর্থনই নয়, এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্বও গ্রহণ করেছিলেন। তখন মওলানা হাবিবুর রহমান কংগ্রেসে যোগদান করেন।
হাবিবুর রহমান বাল্যকালে তাঁদের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ‘মাদ্রাসায়’ পড়েছিলেন। পরে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জালান্দরে, অমৃতসরে এবং সর্বশেষে ১৯১৪ সালে দেওবন্দে যান।
তিনি ১৯২৯ সালে ‘মজলিস্ ই-আহরর’ পার্টি গঠন করেন। ‘আহরর’ শব্দের অর্থ ‘মুক্ত মানুষ’ তাহলে ‘মজলিস-ই-আহররের’ অর্থ হলো ‘মুক্ত মানুষের সংস্থা।’ তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার ও বাংলায় মজলিস-ই-আহরর পার্টিকে সংগঠিত করেন এবং তাকে জনপ্রিয় কর তোলেন।
‘মজলিস-ই-আহররের’ ইতিহাস ও চরিত্র সর্ম্পকে সংক্ষেপে আরও কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। মুসলিম লীগ চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অবলম্বন করার ফলে পাঞ্জাব মুসলিম লীগ থেকে একদল কর্মী মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ১৯২৯ সালে মওলানা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে মজলিস-ই-আহরর গঠন করেন। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের ফলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার যে প্রসার ঘটে তা’ এই প্রতিষ্ঠানটির উপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। মজলিস-ই-আহররের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত নেতাদের ভাষণ থেকে আমরা তার পরিচয় পাই। সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী আবদুল হক তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন, ‘‘আমরা আমাদের দেশবাসীর জন্য এমন স্বাধীনতা চাই, যাতে সাধারণ গরীব লোকেরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারেন।” মওলানা হাবিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘বর্তমান ধনতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে আমাদের গরীবের সরকার গঠন করে তুলতে হবে।” সাহেবজাদা ফজলুল হোসেন আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘‘পুঁজিপতিরা সমস্ত ক্ষমতা আত্মসাৎ করে নিয়েছে, মজুররা তাদের হাতের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, এই অবস্থাকে আর কোনোমতেই চলতে দেওয়া যেতে পারে না।”
‘মজলিশ-ই-আহরর’ ভারতীয় মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগদানের জন্য এবং কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মুসলমান আইন অমান্য আন্দোলনে কারাবরণ করেছিল।
১৯৪০ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘মজলিশ-ই-আহররের’ প্রাদেশিক সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবটি থেকে ‘মজলিস-ই-আহররের’ আদর্শ ও লক্ষ্য পরিস্কারভাবে বুঝা যাবে। মজলিস-ই-অহররের এই সম্মেলন এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে পুনরায় তার এই দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করছে যে, ভারতের পূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা লাভই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। এই স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে দেশের লোক যে দুর্দশার মধ্যে আছে তার প্রতিকার হবে এবং এই স্বাধীনতা ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সহায়ক হবে। এই সম্মেলন এই অভিমত পোষণ করে যে, ভারতকে দ্বিধাবিভক্ত করার যে পরিকল্পনা চলছে, তাকে সাফল্যের সঙ্গে কার্যকরী করা যেতে পারে না। তার ফলে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতার মনোভাব ক্রমশঃই বেড়ে চলবে। এই সম্মেলন মনে করে যে, যেহেতু এই উপ-মহাদেশে এই দুটি অংশের মধ্যে কোনও প্রাকৃতিক সীমারেখা নেই, সেই কারণে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ স্থায়ী পরিণতি হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে ভারত যে সমস্ত প্রদেশে বিভক্ত আছে, স্বাধীনতা লাভের পরেও সেইভাবেই প্রদেশগুলি গঠন করা বাঞ্ছনীয় এবং সম্ভবও বটে। তবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে হিন্দুদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার দিকে দৃষ্টি রেখে সকল প্রদেশের জন্য একই রকম আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এই সম্মেলন আরও মনে করে যে ভারতের সকল বয়স্ক লোকদের স্বেচ্ছা ও স্বাধীনভাবে প্রদত্ত ভোটদানের ভিত্তিতে গঠিত গণ-পরিষদে স্বাধীন ভারতের গঠনতন্ত্র রচিত হওয়া উচিত। একমাত্র সেই গঠনতন্ত্রই সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে।
মুসলিম লীগই সমস্ত ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, ‘মজলিস ই-আহরর’ সব সময় কথায় ও কাজে তাদের এই দাবীর প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত ‘মজলিস-ই-আহরর’ বিরামহীনভাবে তার আন্দোলন চালিয়ে এসেছিল।
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানীর আরও একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। তার উদ্যোগেই কাশ্মীর, কর্পূরথলা, বাহওয়ালপুর, কাদিয়ান প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যে আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।
মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানী আদর্শ ও দৃঢ় চরিত্রের লোক ছিলেন। তিনি গান্ধীজীর নেতৃত্বকে অনুসরণ করে এসেছিলেন। জহরলালের সঙ্গেও তাঁর গভীর অনুরাগের সর্ম্পক ছিল। তা সত্ত্বেও তাদের মুখের দিকে চেয়ে তিনি কখনও তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যেখানেই তাঁর মতভেদ ঘটেছে, তিনি সুস্পষ্ঠভাবে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই স্পষ্টোক্তি সত্ত্বেও তিনি সকলের কাছেই জনপ্রিয় ছিলেন।
মওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানী ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে পরলোক গমন করেন। এই দেশপ্রেমিকের কর্মবহুল জীবন সমগ্র জাতির এক পরম সম্পদ।
ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রসূত
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments