শহীদ আব্দুস সামাদ খান আচকজাই

বালুচ জাতির বাসভূমি বেলুচিস্তান। এই বালুচরা উত্তর পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশের পাখতুন বা পাঠানদের মতো এই ইতিহাসের অজানা কোনো এক অধ্যায়ে সীমান্তের ওপার থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। সে কতকাল আগের কথা, কেনই বা তাদের নিজেদের দেশ ছেড়ে এই দুর্গম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, তা নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে নানারকম মতভেদ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে তারা মোটামুটিভাবে একমত যে এই বালুচরা যে কোনো কারণেই হোক একদিন কাম্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলের আদিভূমি ত্যাগ করে এখানে চলে এসেছিল।

কিন্তু আজকের দিনের বালুচরা এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। বংশপরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত অতীত যুগের সেই স্মৃতি তাদের মন থেকে একেবারেই মুছে গেছে। এই বেলুচিস্তানকেই তারা তাদের নিজস্ব বাসভূমি এবং অবিভক্ত ভারতকেই তারা তাদের স্বদেশ বলে জেনে আসছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে বেলুচিস্তানের বালুচরা উত্তর পশ্চিম প্রদেশের পাখতুন বা পাঠানদের মতোই এক উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এরা সকলেই ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা এদের রাজনৈতিক জীবনে কোনোরূপ ছায়াপাত করতে পারেনি। সীমান্ত প্রদেশের পাখতুনদের মতো এরাও ভারতের স্বাধীনতার জন্যই সংগ্রাম করে এসেছে। সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের জননেতা আবদুল গফফার খানের মতো যিনি বালুচদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শোষণনীতির অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন, সেই আবদুস সামাদ খান বা ‘বালুচ গান্ধী’র নাম সারা উপমহাদেশে সুপরিচিত।

সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের মতো বালুচদের মাতৃভাষা পশতু। এই পশতু ইন্দো-ইরানীয় আর্য ভাষার একটি শাখা। ব্যক্তিচরিত্র জীবনযাত্রার ধরন ও সামাজিক দিক দিয়ে এই দুটি জাতির মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম এবং অপরিসীম দুঃখ লাঞ্ছনা ভোগের মধ্য দিয়ে এই দুটি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে চলেছে। যে দুজন জনপ্রিয় জননেতা একই সময়ে এই দুটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তাদের দুজনের রাজনৈতিক জীবনেও আশ্চর্য মিল দেখা যায়। সমাজের কল্যাণ ও জাতীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই দুজন নেতা বিদেশী ও দেশীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে এসেছেন। এরা দুজনই শান্তিপ্রিয় স্বভাবের মানুষ, কিন্তু শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের অভিলাষে এরা কোনোদিনই জাতির দুশমনদের সঙ্গে অবাঞ্ছনীয় আপোস বা তাদের আছে আত্মসমর্পণ করতে পা বাড়ান নি।

এটা খুবই বিস্ময়ের কথা যে প্রায় একই সময় অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এই দুটি জাতির মধ্যে এই দুজন জননায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল। আবদুল গফফার খান ১৮৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খুব সঠিকভাবে বলা না গেলেও একথা বলা চলে ১৮৯৫ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে আবদুস সামাদ খানের জন্ম হয়েছিল। এদের দুজনের সংগ্রামী জীবন ও অদম্য আদর্শনিষ্ঠা বহু বিভক্ত সারা ভারতের অধিবাসীদের এক বিরাট সম্পদ, এক বিরাট ঐতিহ্য।

আবদুস সামাদ খান কোয়েটার নিকটবর্তী গুলিস্তান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান। তাঁর পিতা খান নূর মহামেদ খান ছিলেন একজন ধনী জমিদার ও আচকজাই কওমের (ঃৎরনব) সরদার। আবদুস সামাদ খানের অপর দুই ভাই এর নাম আবদুস সালাম খান ও মহম্মদ আয়ুব খান।

ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর সরকারের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ফলে পাঠান ও বালুচদের এই সমস্ত সরদার অর্থাৎ সমাজপতিরা তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও চরিত্র থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষদের নানাভাবে শোষণ করে চলত। সীমান্ত প্রদেশের মতো বেলুচিস্তনেও তারা ব্রিটিশ অফিসারদের এজেন্ট বা দালাল হিসাবে কাজ করে আসছিল। এই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও আবদুস সামাদ খান তাঁর স্বাভাবিক গণমুখী চরিত্র থেকে কোনোদিনই ভ্রষ্ট হননি। তাই তাঁর মহিমাময় জীবন দুঃখ দুর্দশা ও অত্যাচারে লাঞ্ছিত সমগ্র বালুচ জাতির সামনে এক অনির্বাণ আদর্শরূপে বিরাজ করছে।

তখনকার দিনের বেলুচিস্তানে আধুনিক শিক্ষালাভের যেটুকু সুযোগ সুবিধা ছিল, তা শুধু অবস্থাপন্ন ঘরের লোকদের ভাগ্যেই ঘটত। আবদুস সামাদ খান সমাজের রীতি অনুযায়ী শৈশবে মক্তবে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। পরে তিনি তাঁর নিজ গ্রাম গুলিস্তানে আধুনিক স্কুলেও পড়েছেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব হয়নি। তা হলেও ইতিমধ্যে তিনি উর্দু ফারসী ও পশতু ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন স্থগিত থাকলেও তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য সব সময়ই আগ্রহশীল ছিলেন। বহুকাল বাদে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আয়ুব খানের সামরিক শাসনের আমলে তাঁর ১৯৫৮-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জেল জীবন যাপনের সময় তিনি পর্যায়ক্রমে ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট এবং পরিশেষে সসম্মানে বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন তাঁর বয়স ৭০-এর কাছাকাছি।

আবদুস সামাদ খান এই সত্যটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমাজের আমুল সংস্কার ছাড়া শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই পশ্চাৎপদ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বালুচ জাতির সত্যিকারের উন্নতি কখনও সম্ভব হতে পারে না। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি আর তার কয়েকজন সহকর্মী আঞ্জুমান-ই-বতন নামক একটি সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। আঞ্জুমান মানে সমিতি আর বতন (ওয়তন) হচ্ছে স্বদেশ। এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে তারা অনেকগুলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খুবই আশ্চর্যের কথা, সীমান্ত প্রদেশের নেতা আবদুল গফফার খানের কর্মজীবনও ঠিক এইভাবে শুরু হয়েছিল।

ইতিমধ্যে ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিরাট রূপান্তর ঘটে চলেছিল। মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান সারা ভারতের জনগণের মনে এক বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করে তুলেছিল। আবদুস সামাদ খান এই ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। এবার তিনি নিজ প্রদেশ বেলুচিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে কাজে নামলেন। সেদিন প্রতিবেশী পাঠান জাতির মতো বালুচরাও এই আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিল। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবদুস সামাদ খান কংগ্রেস সংগঠনে যোগদান করেছিলেন এবং তাঁর আঞ্জুমান-ই-বতন প্রতিষ্ঠানটি সাংগঠনিকভাবে ভারতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করেছিল। এই ক’টি বছরের মধ্যেই তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯২৮-২৯, এই বছরটি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই সময় তিনি উত্তর ভারতে বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান নওজোয়ান ভারত সভার ঘনিষ্ট সংস্পর্শে আসেন। তার ফলে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে নূতন চরিত্র সঞ্চারিত হয়ে উঠেছিল।

তিনি ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি আরও কয়েকটি রাজনৈতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে নূতন নূতন অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। লাহোরের এক সভায় তিনি বেলুচিস্তানে ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর দমন নীতির প্রতিবাদ করে এক অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। লাহোর থেকে বেলুচিস্তানে ফিরে আসার সময় তিনি বহু রাজনৈতিক পুস্তক পুস্তিকা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

১৯৩০ সালে আবদুস সামাদ খান ও তাঁর দুই ভাইকে গ্রেফতার করে কোয়েটায় নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানকার জির্গার বিচারে সরকার বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাঁরা দুই বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আবদুস সামাদ খান সরকার কর্তৃক আরোপিত কঠিন বিধি-নিষেধের মধ্য দিয়েও তাঁর রাজনৈতিক কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

বেলুচিস্তানের বাইরে সিন্ধু প্রদেশের কোনো কোনো অঞ্চলেও যথেষ্ট পরিমাণ বালুচ জাতির লোকের বসতি আছে। হায়দ্রাবাদে (সিন্ধু) বালুচদের এক সম্মেলনে আবদুস সামাদ খান বেলুচিস্তানের অধিবাসীদের নিদারুণ দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে এক বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় ভারতের সকল প্রদেশের অধিবাসীদের তিনি এই আবেদন জানান যে তারা যেন সম্মিলিত প্রচেষ্টার সাহায্যে হায়দ্রাবাদের লোকদের এই দুরবস্থার অবসান ঘটান, যাতে তারা আর সকলের মতো সমান সুযোগ সুবিধা, সমান

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice