রেলওয়ে শ্রমিক নূর হোসেন

নূর হোসেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম ডিব্রুগড়ের রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কাজে অপশন দিয়ে ঢাকায় চলে এলো। ডিব্রুগড়ের ওয়ার্কশপের শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানই ছিল বেশী। তারা সবাই পূর্ব-পাকিস্তানের লোক। শুধু নূর হোসেন নয়, এরা সবাই ফিরে এল, একজনও বাকী রইল না। কেনই বা থাকবে? তারা ভালো ভালো লোকের মুখে শুনেছে, পাকিস্তান যখন আসবে, তখন দেশে অভাব, অনটন, অশান্তি, শোষণ, জুলুম, অত্যাচার কোনো কিছুই থাকবে না। পাস্তিানের মানুষেরা সবাই মানুষের মতো বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। এতোদিনে, এতো লোকের চেষ্টায়, এতো ক্ষয়-ক্ষতি, রক্তারক্তির পর সেই পাকিস্তান যখন এসেছে, তখন তাকে ছেড়ে এতো দূরে ওই বিদেশ-বিভূঁয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয়?

কাজেই আর সকলের মতো অপশন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার ব্যাপারে তার মনে কোনো দ্বিধা বা সংশয় ছিল না। তাহলেও অপশনের কাগজে সই দেওয়ার আগে এই বিষয়টা নিয়ে সে মহেন্দ্র দত্তের সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিল। মহেন্দ্র দত্ত ডিব্রুগড় রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ইউনিয়নের নেতা। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল সমস্যা দেখা দিলে নূর হোসেন তার সঙ্গে পরামর্শ করে নেয়। কেনো যে করে, নূর হোসেন নিজেই তা বুঝে উঠতে পারে না। মহেন্দ্রর দত্ত তাকে উপদেশ বা পরামর্শ দেবার কে? হ্যাঁ, এমন এক সময় ছিল যখন সে শ্রমিক ইউনিয়নের সভ্য ছিল। ইউনিয়নের নির্দেশ মেনে কাজ করত। এই মহেন্দ্র দত্তই প্রথমে তার চোখ ফুটিয়ে ছিল। তার কাছ থেকেই সে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম ছবক নিয়েছিল। কিন্তু সে দিন তো আর এখন নাই। বহু লোকের বহু দিনের চেষ্টার ফলে তাদের ইউনিয়ন যখন বেশ দানা বেঁধে উঠেছে, তখন চেরাগ খাঁর দলবল বিভেদের ঝাণ্ডা ঘাড়ে নিয়ে রেলওয়ে মুসলিম এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন গড়ে তোলবার জন্য আওয়াজ তুলল।

এখানকার শ্রমিক ইউনিয়নকে গড়ে তুলতে অনেক সময় অনেক মেহনত আর অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু ভাঙ্গন ধরাতে বেশী সময় লাগল না। কিছু দিনের মধ্যেই এই ইউনিয়নের পাশাপাশি পালটা মুসলিম এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন দাঁড়িয়ে গেল। প্রায় সব মুসলমান শ্রমিকই চেরাগ খাঁর এই নতুন ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল। বাকি সামান্য কজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পুরানো ইউনিয়নটাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। চেরাগও তার দলের লোকেরা ‘গাদ্দার’ বলে তাদের গাল দিত।

নুর হোসেন নিজেও এই পালটা ইউনিয়নে শামিল হয়ে গিয়েছিল। খাঁটি মুসলমান হলে তাকে যে কোনো অবস্থায় মুসলিম ঐক্যকে জোরদার করে তোলার জন্য যথাশক্তি চেষ্টা করা উচিত, চেরাগ খাঁর চেলা-চামুণ্ডারা এই কথাই তাদের সবাইকে বোঝাত। নূর হোসেন এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত ছিল। একমত ছিল বলেই সে পুরানো ইউনিয়ন ছেড়ে মুসলমান শ্রমিকদের নিজস্ব ইউনিয়ন মুসলিম এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশনে যোগ দিয়ে ছিল। মহেন্দ্র দত্ত এতোদিন ধরে তাকে যেই শিক্ষা দিয়ে এসেছে, কার্যতঃ সে তার বিপরীত কাজই করে চলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে প্রয়োজনের সময় পরামর্শ নেবার জন্য মহেন্দ্র দত্তের কাছে না গিয়ে পারত না। এ যে কি রহস্য নূর হোসেন নিজেও তা ঠিক বুঝে উঠতে পারত না।

অপশন নেওয়ার ব্যাপারে মহেন্দ্র দত্ত বলল, আপনার বাড়ী, ঘর আপনজনেরা সবাই যখন পাকিস্তানে তখন আপনার অপশন নিয়ে সেখানে চলে যাওয়াই তো ভালো। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। এখানে যা করেছেন, ওখানে গিয়ে ওই ভুল যেন আবার করবেন না। ওখানে গিয়েও আপনাকে রেলওয়ে ওয়ার্কশপেই কাজ করতে হবে। এখানে যে সমস্ত অভাব-অভিযোগ আর জুলুম চলছে সেখানেও এইগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। শ্রমিক হিসাবে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে আন্দোলন করতেই হবে। আর আন্দোলনের শক্তি রয়েছে সমস্ত শ্রমিকের ঐক্যের মধ্যে।

সেখানে গিয়ে যেন আবার পালটা ইউনিয়ন খাড়া করে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা ডেকে আনবেন না। যারা আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেংগে খাচ্ছে, তারা তো ঠিক এই জিনিসটাই চায়।

নূর হোসেন মহেন্দ্র দত্তের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, এ সব কি কথা বলছেন আপনি! আমরা স্বাধীন পাকিস্তান পেয়ে গেছি, এর পরে আবার শ্রমিকেদের আন্দোলন করতে হবে কেন? পাকিস্তানের কলকারখানা আর ব্যবসা বাণিজ্যের বেশীর ভাগ তো মুসলমানদের হাতে। আর পাকিস্তানের মন্ত্রীরাও মুসলমান। মুসলমান হয়ে তাঁরা মুসলমানদের উপর জুলুম করবেন কেন? তবে আর পাকিস্তান হয়েছে কিসের জন্য?

রেলওয়ে শ্রমিক নূর হোসেনের মুখে তার জীবন বৃত্তান্ত শুনছিলাম। তার এই শেষ কথাটা শুনে আর না হেসে থাকতে পারলাম না। নূর হোসেন নিজেও হাসল। হেসে বলল, হাসছেন আপনি? হাসবার কথাই তো। সত্যি কথাই, কি বোকাই যে তখন ছিলাম। শুধু কি আমি? আমাদের মধ্যে অনেকেই তখন এই ভাবেই চিন্তা করত। আমরা কি এক স্বপ্নের মধ্যেই না ডুবে ছিলাম। আমার কথা শুনে মহেন্দ্র দত্তও সেদিন হেসেছিলেন। সে হাসির মানে সেদিন বুঝতে পারি নি। এখন বুঝতে পারি।

ঢাকা এসে নূর হোসেন সম্পূর্ণ নূতন এক পরিবেশের মধ্যে পড়ল। এখানে কাজে ঢোকার পরই সে মুসলিম এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশনের খোঁজ-খবর নিয়ে দেখল এ-নামে একটা ইউনিয়ন আছে বটে, কিন্তু এখানকার অধিকাংশ শ্রমিকের মধ্যে তাদের খুব সামান্যই প্রভাব আছে। বরঞ্চ দালাল ইউনিয়নের লোক বলে তারা তাদের ঘৃণাই করে।

এই নূতন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে নূর হোসেন অবাব হয়ে গেল। এখানে এসে সে যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে, সবই তার কাছে বিচিত্র বলে মনে হয়। একদিন ওয়াকর্সশপে কাজ করতে করতে সে তার সেই পুরানো প্রশ্নটা তুলেছিল।

কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, পাকিস্তান হাসিল হয়ে যাওয়ার পর এ সমস্ত আন্দোলন করবার প্রয়োজনটা কি? তার কথা শুনে আশে পাশে যারা কাজ করছিল, সবাই হেসে উঠল। একজন বলল, এ কথা তো আমরা মন্ত্রীদের আর সরকারী হোমরা-চোমরাদের মুখে সব সময়ই শুনে আসছি। আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখবার জন্য ওরা এই সমস্ত মিঠা মিঠা কথা শোনায়। তুমি কি সরকার পক্ষের লোক না কি? চেরাগ খাঁর দলের লোকদের মতো তুমিও কি ওদের দালালিতে নাম লিখিয়েছ?

নূর হোসেন সব কথার তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারে না। পাকিস্তান সরকার আর পাকিস্তানের মেহনতি মানুষ ওরা কি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুটো পক্ষ? এ দেশের মেহনতী মানুষদের এতদিনের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান হাসিল হয়েছে। তাদেরই ভোটের জোরে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার সেই সাধারণ মেহনতী মানুষের অভাব অভিযোগ মিটাতে বা সুযোগ সুবিধা দিতে চাইছে না, ্তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখছে এবং মেহনতী মানুষদের বাঁচতে হলে মিছিল করে, সভা করে আর ধর্মঘট করে সেই সমস্ত দাবী দাওয়া আর অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবেÑ এইটাই কি সত্যি? আর এ যদি সত্য হয়, তবে এর মানে কি? এতোদিন যে সব কথা সে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে মনে করে এসেছে, আজ এর ওর মুখে নানা কথা শুনে আর নিজের চোখেও দুটো একটা ঘটনা দেখে তাদের সম্পর্কে তার নিজের মনেও একটু একটু করে সংশয়ের কীট প্রবেশ করছিল।

এখানে আসার পর যে জিনিসটা তার মনে সবচেয়ে বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছিল, তা হচ্ছে এখানে রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের বাদ-বিবাদ বা বৈষম্যের কোনো প্রশ্ন একেবারেই উঠে না। শহরে এমন অনেক আছে যারা যে কোনো একটু সুযোগ বা ছুতা পেলে সেই সব প্রশ্নকে খুঁচিয়ে তুলতে চায়।

কিন্তু রেলওয়ে শ্রমিকদের মনকে তা স্পর্শ করতে পারে না। অথচ ডিব্রুগড়ের শেষের দিকটায় এই সব নিয়েই তো তারা মাতামাতি করত। কিন্তু এখন এখানকার পরিবেশে তার নিজের

লগইন করুন? লগইন করুন

বাকি অংশ পড়তে,

সাবস্ক্রাইব করুন

প্রারম্ভিক অফারটি


লেখাটি পড়তে
অথবা

সাবস্ক্রাইব করে থাকলে

লগইন করুন

You Might Also Like

Comments

Leave A Comment

Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).


Get Newsletter

Featured News

Advertisement

Voting Poll (Checkbox)

Voting Poll (Radio)

Readers Opinion

Editors Choice