শোভনার বাঁধ
অনুচর জমিদারদের নিয়ে গোপন পরামর্শ সভায় বসেছিলেন খুলনার জমিদারদের মধ্যমণি স্বনামখ্যাত রায় বাহাদুর। কি করে কৃষকদের কাছ থেকে সমস্ত জমি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের খাস করে নেওয়া যায়, এই নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছিল। উদ্দেশ্যটা সাধু। কিন্তু আইনের নানা রকম বাধা রয়েছে। সেটা না হয় কোনো মতে সামলানো গেলো কিন্তু স্বদেশীওয়ালাদের মধ্যে ওই যে একটা দল আছে, যারা ‘কৃষক‘ ‘কৃষক’ বলে চেঁচিয়ে মরছে, ওদের নিয়েও চিন্তা করতে হয়। ইংরাজদের তাড়িয়ে দিয়ে নাকি দেশ স্বাধীন করবে, তারপর কৃষকদের করবে জমির মালিক। যেন মামার বাড়ীর আবদার। কিন্তু ওরা সহজ পাত্র নয়, একটু কিছু হলেই হৈ হুল্লোড় বাঁধিয়ে বসে। রায় বাহাদুরের কপাল চিন্তার রেখায় কুঞ্চিত হয়ে উঠে বার বার।
হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ চমকে যায় তার চোখে-মুখে, পাশবিক হাসিতে মেদ-বহুল দেহটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। সাঙ্গো পাঙ্গোরা ঝুঁকে পড়ে তার দিকে, প্রায় একই সাথে তারা জিজ্ঞাসা করে-কি হলো? পথ কিছু বের করতে পারলেন?
পারবেন না? কত পুরুষ ধরে জমিদারী চালিয়ে আসছেন, রক্তে মাংসে কত কুটিল বুদ্ধি আর ষড়যন্ত্রের পোকা কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে তার হিংস্র তৃপ্তির হাসি। শ্বাপদের পায়ের থাবার তলায় নিরীহ মেষ শাবক, এখন রসিয়ে রসিয়ে খেলেই হলো।
রায় বাহাদুর এবার সোজা হয়ে বসে গম্ভীর মুখে সকলের দিকে তাকালেন-শুনুন আপনারা, একটা বুদ্ধি আছে। সেই লাইনে কাজ করতে পারলে দু’এক বছরের মধ্যেই আগাছা প্রজার দল উচ্ছেদ হয়ে জমি পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে যাবে। অথচ আমাদের গায়ে একটুও আঁচড় পড়বে না। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না কিন্তু অত্যন্ত গোপনে এই কাজ করতে হবে। কেউ জানতে পারবে না, শুধু বিশ্বস্ত নায়েব গোমস্তারাই জানবে। আর আমাদের প্রত্যেকের এলাকায় একই সাথে এ কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে।
খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল এক ফসলার দেশ, আর সে ফসল হচ্ছে ধান। সে ধান হওয়া অসম্ভব যদি নোনা জল ঠেকাবার জন্য দৃঢ় বাঁধবন্ধী না করা যায়। কাজেই ওই বাঁধ ভাঙ্গতে হবে, বাঁধ করতে দেওয়া হবে না।
তা কেমন করে হয়? সকলের মনেই এক প্রশ্ন। কৃষকরা তো নিজেদের উদ্যোগে দলবদ্ধ হয়ে প্রতি বৎসর বাঁধবন্ধী করে। বাঁধ যে তাদের প্রাণ। ছেলের মৃত্যু তারা সহ্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু বাঁধ তারা ভাঙ্গতে দিতে পারে না কোনো অবস্থাতেই।
আরে বাঁধ ভাঙ্গা নয়, বাঁধ আমরা ভাঙ্গতে যাব কেন? আর তা করলে সেই স্বদেশীওয়ালা ছোকড়ারা সুযোগ পেয়ে যাবে। তা নয়। যাতে ওরা বাঁধ বাঁধতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমত বিভিন্ন এলাকায় জমিদারদের হাতে যে খাস জমি আছে বা হবে, সেই জমি এখন থেকে আর নতুন করে টাকা খাজনায় পত্তন দেওয়া হবে না, এমনিই পড়ে থাকবে। কাজেই বাঁধ বাঁধবার সময় ওই জমির লোক পাবে না। দ্বিতীয় বাকী খাজনার জন্য তালিকা করে জমি খাস করে নিতে হবে, কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না, মামলায় মামলায় তাদের জের বার করতে হবে। তৃতীয়ত এইটিই হলো মোক্ষম, যাকে বলে ব্রহ্মাস্ত্র। কৃষকদের মধ্যে এমনিতেই নানাভাবে বিভেদের সৃষ্টি হয় এবং আগে থেকেও কিছু কিছু বিভেদ চলে আসছে—সামাজিক ঝগড়া, সাম্প্রদায়িক ঝগড়া, ব্যক্তিগত ঝগড়া, পাড়ায় পাড়ায় ঝগড়া প্রভৃতি। আমাদের এই বিভেদগুলির সাহায্য নিতে হবে। এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলকে উস্কে দিতে হবে।
জমিদাররা অন্ধকার কুটিল পথে এগিয়ে চলে তাদের অভিপ্রায় চরিতার্থ করবার জন্য, কৃষকদের জমিহারা, সর্বহারা করার জন্য। মামলায় মামলায় কৃষকরা কাহিল হয়ে পড়ে দিনের পর দিন। মামলার যেন মৌসুম পড়ে গেছে। পেনাল কোডের সব কয়টা ধারা কৃষককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে-জমির স্বত্ত্ব নিয়ে, ধান কাটাকাটি নিয়ে, জমির আল নিয়ে, গরু-ছাগল নিয়ে, চুরি, রাহাজানি, মারামারি, ঘর জ্বালানি এমন কি মেয়েছেলে নিয়েও সত্য মিথ্যা মামলা শুরু হয়ে গিয়েছে নিজেদের মধ্যে। একদল হাজতে যাচ্ছে, টাকা পয়সা খরচ করে উকিল মোক্তার লাগিয়ে জামিনে বের হয়ে আসছে। পর মুহূর্তে আরেক দল হাজত বা জেলের পথে পা বাড়াচ্ছে, একেবারে নরক গুলজার। জমিদারের আকাক্সিক্ষত কৃষক-মেধ যজ্ঞের ধোঁয়া আকাশ ভেদ করে উঠছে। সেই যজ্ঞে পুর্ণাহুতি পড়ছে, কৃষকদের বাকি খাজনার জন্য জমি থেকে উচ্ছেদের মামলায়।
নৌকায় করে চাল ডাল নিয়ে বহু দূরে খুলনা টাউনে গিয়ে মামলা করতে হচ্ছে কৃষককে। জমি চাষ বা বাঁধবন্ধী করার সময় নাই। কৃষকের উপর কোর্টের বহু নোটিশ অজ্ঞাত কারণে গোপন হয়ে যাচ্ছে, মামলাও এক তরফা চলছে। কৃষক কিছুতেই মানতে পারছে না। তখনই শুধু মানছে যখন কোর্টের চাপরাশীসহ জমিদারের পাইক বরকন্দাজ ঢোল সহরতে এসে জানিয়ে দিচ্ছে-জমি এখন থেকে আর কৃষকদের নয়, জমি এখন জমিদারের খাস।
স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির উপর সমানভাবে আক্রমণ চলছে। অন্য এলাকা থেকে ভাড়া করা গুণ্ডা প্রকৃতির এক দল কৃষক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এদের উপর। হিন্দু এলাকায় হিন্দু গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চমৎকার সূক্ষ্ম ব্যবস্থা, একটুও ফাঁক নাই কোথাও, ঘরের চাল কেটে দিচ্ছে, বেড়া দরজা ভেংগে দিচ্ছে, ঘটি-বাটি বদনা কলসী লুট হচ্ছে, গরু ছাগল হাঁস মুরগী যা পাচ্ছে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো বাধা দেবার এমনকি প্রতিবাধ করবারও শক্তি নাই। নিরুপায় অসহায় কৃষক রুদ্ধ নিশ্বাসে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তার ছোট সংসারটির পরিণতি। কারু কারু হাত দুটি বুঝি ক্ষণিকের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। চোখ দুটি ধক ধক করে জ্বলে ওঠে, সেই চোখের কোণে কোণে রক্তের চিহ্ন। হায়রে, দুর্বলের নিস্ফল আস্ফালন।
ডুমুরিয়া থানার শোভনা ইউনিয়নের প্রায় বিশ হাজার বিঘা বিশাল জমির আবাদ এলাকা পড়ে আছে। আগে বাঁধবন্ধী হতো নিয়মিত, ফসলও পেত কৃষক প্রচুর পরিমাণে। এখন সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে সমান হয়ে গেছে। নোনা জল জমির উপর থৈ থৈ করছে। ভাটিতে সে জল নেমে যায়, আর দেখা যায় রোদের তাপে জায়গায় জায়গায় সাদা সাদা ফুল ফুটে উঠেছে। জমির এখানে ওখানে দু’একটি কেওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আশ্রয় নিয়েছে সাদা ও কুচি বকের দল। ফসল নাই একটি দানাও। সমস্ত জমি রিক্ত। জল্যদেশে এ আরেক ধরনের মরুভূমি।
কৃষকের ছোট বড় ধানের গোলাগুলি ভেঙ্গে গলে পচে ঝরে পড়ছে, ঘর দুয়ার ছন্ন ছাড়া, লক্ষ্মী ছাড়র মতো। নোনা জল উঠান ডুবিয়ে ঘরের ভিটার উপর আছড়ে পড়ছে, ভিটার মাটি ঝপ ঝপ করে ভেঙ্গে পড়ছে। গরু যে খাবে তারও উপায় নাই, ঘাস সব পচে গেছে। কঙ্কালসার গরুগুলি দাঁড়িয়ে ধুঁকছে। মানুষের চলছে অর্ধাহার, অনাহার কেউ কেউ লম্বা পাতি ঘাস সংগ্রহ করে মাদুর বুনে সপ্তাহান্তে হাটে বাজারে বিক্রি করে আট-দশ আনা যা পায় তাই দিয়ে চাল কিনে আনে। অনেকে মাছ বিক্রি করে। ছিল কৃষক হয়ে গেল মৎস্যজীবী। অনেক দল চলে যায় অন্যত্র কৃষাণ খাটতে বা জন খাটতে। বছরের পর বছর ফসল হয় না এক দানা, তবুও কৃষক জমি বিক্রি করতে চায় না। না খেয়ে মরবে, তা সত্বেও সে ঐ জমিতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। জমির দাম নামতে নামতে বিঘা প্রতি একশো দেড়শো টাকা থেকে দশ বার টাকায় নেমে গেছে, নোনা জলেরও বোধ হয় এর চেয়ে দাম বেশী। তবুও না, অদ্ভুত এক অন্ধ মায়া এদের জমির উপরে। জন খেটে, মাদুর বিক্রি করে যে টাকা উপার্জন করে, তা থেকে আগে খাজনা শোধ করে, তারপর বাকি টাকায় খাওয়া পরা চালায়। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন চলবে।
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments