দিশাকাক
সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে বিদেশী সওদাগরের বাণিজ্য তরী বাবেরু রাজ্যের ঘাটে এসে ভিড়ল। বিদেশী সওদাগরের তরী ঘাটে এসেছে, এই খবর শুনতে পেলে নগরে সাড়া পড়ে যায়। ছেলে বুড়ো কৌতূহলী হয়ে দেখতে ছুটে আসে। আজও তাই হয়েছে-ঘাটে ভিড় জমে গেছে। সওদাগরের অনুচরেরা উপস্থিত নগরবাসীদের উদ্দেশ্য করে বিচিত্র সুরে আর বিচিত্র ভঙ্গিতে তাদের নানাবিধ পণ্যের গুণাগুণের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে। লোকের মন কেমন করে আকর্ষণ করতে হয়, সে সব কায়দা-কানুন এরা ভালো করেই জানে। এদের এই বিজ্ঞাপনের ভাষা আর ভঙ্গি বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বড়রা আসে সাগরের উপরের নানা দেশের নানা রকম জিনিস দেখে চোখের সাধ মিটাতে, মাল নিয়ে দরাদরি করতে আর সামর্থ্যে কুলালে কিনতে।
কিন্তু আজ আর কারু কোনো দিকে মন নেই, সবাই একদৃষ্টিতে তাকিকে আছে তরণীর সামনের দিকে, যেখানে মাস্তুলের ধারে কালো কুচকুচে পাখীটি ঘাড় বাঁকিয়ে সবাইকে এক নজড় দেখে নিচ্ছে।
বাঃ বাঃ কি সুন্দর পাখী! কেমন রং, কেমন চোখ, কেমন ঠোঁট আর কি সুন্দর গ্রীবা ভঙ্গি। এমন পাখী আমাদের দেশে নেই তো? এমন সুন্দর পাখী আমরা জন্মে দেখিনি। পাখীর রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ।
সওদাগরের লোকেরা মজা পেয়ে গেলো। তারা বলল, আমাদের পাখীর শুধু রূপই নাই, গুণও আছে।
কি গুণ আছে তোমাদের পাখীর? তারা প্রশ্ন করল। নিজের চোখেই দেখ না বলে তাদের মধ্যে একজন শিস দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাখী ডেকে উঠল—ক্ক, ক্ক, কা, কা, আরও কত রকমের বিচিত্র আওয়াজ। বাবেরুর লোকেরা দেখেশুনে অবাক। একই গলা থেকে এতো রকমের আওয়াজ কি করে বেরিয়ে আসে।
যে শিস দিয়েছিল সে এবার আঙ্গুলে তুড়ি বাজাল। বাস, আর কি কথা আছে! সঙ্গে সঙ্গে পাখী তার গান বন্ধ করে নাচতে শুরু করে দিল। সত্যি তো, আশ্চর্য তোমাদের এই পাখী, রূপে গুণে কারু সঙ্গে তুলনা হয় না, দর্শকের মধ্যে একজন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, তোমাদের এই পাখীর নাম কি গো?
ঐ পাখীর নাম কাক, আমরা একে বলি দিশাকাক।
এবার ক্রেতার দল এগিয়ে এসে বলল, এ পাখী আমরা কিনব। বল, ওর দাম কত? কিন্তু পাখীর মালিকরা পাখীকে কিছুতেই ছাড়বে না। তারা বলল, এ পাখী আমরা বিক্রি করার জন্য আনিনি। এ পাখীর কত গুণ! তা ছাড়া এ আমাদের পথ দেখায়। একে কি আমরা ছাড়তে পারি!
ওপক্ষের একজন বলল, আরে ভাই, তোমাদের দেশে এ পাখী তো কতই আছে! আমাদের সারা রাজ্যে যে একটিও নেই।
এ নিয়ে বহুক্ষণ পর্যন্ত সাধাসাধি চলল। শেষ পর্যন্ত তারা উচ্চ মুল্য পেয়ে কাকটাকে তাদের কাছে বিক্রি করে দিল। সওদাগর আর তার লোকজনেরা বাবেরুর লোকদের এই আহাম্মকী দেখে নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহাসি করল এবং পরের বছর একটা ময়ূর নিয়ে এলো এবং এই ভাবে ময়ূরটা তাদের হাতে গছিয়ে দিয়ে বহু টাকা ঠকিয়ে নিয়ে গেলো।
উপরে এই যে গল্পটা বলা হল, এটা জাতকের গল্প। গল্পটার নাম বারেরু জাতক। গল্পটা বহুদিন আগে পড়েছিলাম। ভালো করে মনে নেই। তাই নিজের মনের মতো করে গল্প সাজিয়ে বললাম। তবে গল্পের সারাংশটা ঠিকই আছে।
জাতকের গল্পগুলি বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েক শো বছর পরে সংকলিত। কিন্তু গল্পগুলো তার বহু আগে থেকে মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছিল। জাতকের গল্পগুলি গল্পই ইতিহাস নয়। কিন্তু কয়েকটি গল্পের মধ্যে ইতিহাসের কিছু কিছু উপাদন রয়ে গেছে। সেদিক থেকে এ গল্পটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতকের এই গল্পটির নাম বাবেরু জাতক। পণ্ডিতদের মতে এই বাবেরু হচ্ছে ব্যাবিলন। সুদূর অতীতে এই উপমহাদেশের বণিকরা যে মেসোপোটেমিয়ার বাণিজ্য করতে যেত, এই গল্পটি তার স্মৃতিটুকু বহন করে আছে। সেদিক থেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বহন করছে বলে গল্পটি খুবই মূল্যবান। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ভাগে মেসোপোটেমিয়ায় (ইরাক) খননকার্যের ফলে যে সব তথ্য উদ্ধার করা গেছে তার ফলে উপরোক্ত কথার সত্যতা সুপ্রমাণিত হয়েছে, অর্থাৎ সুদূর অতীতে মেসোপোটেমিয়া আর এই উপমহাদেশের মধ্যে সত্য সত্যই বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
‘বাবেরু জাতক’-এর কাহিনিটির মধ্যে আরও একটি ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘দিশাকাক’-এক কথা। বাণিজ্য তরী পরিচালনার ব্যাপারে সত্য সত্যই কাককে ব্যবহার করা হতো। দিক নির্দেশ করার ব্যাপারে কম্পাস যন্ত্রের যেই ভূমিকা, কাক সেই ভূমিকার কিছুটা প্রতিপালন করত। সেই জন্যই তাকে বলা হতো ‘দিশাকাক’।
এটা খ্রিষ্টপূর্ব দু’হাজার বছরেরও আগেকার কথা। এই উপমহাদেশ থেকে যেসব বাণিজ্য তরী মেসোপোটেমিয়ার দিকে পণ্যে বোঝাই হয়ে যাত্রা করত, সেগুলো নিরাপত্তার জন্য যতটা সম্ভব উপকূল ঘেঁষে চলতে চেষ্টা করত। কিন্তু সময় সময় বায়ু-তাড়িত হয়ে, স্রোতের টানে বা পরিচালনার ত্রুটির ফলে এই সমস্ত তরী উপকূল থেকে দূরে গভীর সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। তখন উপকূলের চিহ্নও দেখা যেত না। ফলে দিক-কুল জ্ঞানহারা হয়ে তারা দিক-বিদিকে ঘুরে মরত। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করবার জন্য তাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হতো। এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি তরীতে তারা একটি করে ‘দিশাকাক’ রাখতো। কূলের দিশা হারিয়ে ফেলে বিপন্ন হয়ে পড়লে নাবিকরা কাকটিকে মুক্ত করে দিত। কাকটি ছাড়া পেয়ে তার স্বভাবজাত শক্তির সাহায্যে নিকটতম পথ ধরে উপকূলের দিকে উড়ে যেত। নাবিকরাও তার অনুসরণ করে তরী চালিয়ে নিয়ে যেত। বাবেরু জাতকে আমরা এই ‘দিশাকাক’-এরই বিবরণ পেয়েছি।
‘বাবেরু জাতকে’র কাহিনিতে বলা হয়েছে যে, বাবেরুর লোকেরা দিশাকাক-এর ব্যবহার জানা দূরে থাক, কাকই কোনোদিন চোখে দেখেনি। এই কথাটা সত্যি বলে মনে হয় না। কেননা সে যুগে এই অঞ্চলের সমুদ্রগামী জাতিগুলোর অনেকের মধ্যেই সম্ভবত এই দিশাকাক ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। ইহুদীদের ওল্ড টেষ্টামেন্টে বর্ণিত মহাপ্লাবন থেমে আসার পর হজরত নূহ স্থলভূমি সন্ধান করে বার করবার জন্য প্রথমে একটি কাককে এবং তারপর একটি পায়রাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। একে ‘দিশাকাক’ ব্যবহার করার রীতি ছাড়া আর কি বলা চলে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার। বাইবেল বর্ণিত এই জলপ্লাবনের কাহিনি ইহুদীরা সুমেরীয়দের কাহিনি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সুমেরীয় জলপ্লাবনের কাহিনির নায়ক ছিলেন ‘জিউসদ্দা’। এই ‘জিউসদ্দা’র চরিত্রকে আদর্শ করেই হযরত নূহের চরিত্র অংকন করা হয়েছিল। কাজেই সুমের বা ব্যাবিলনের লোক ‘দিশাকাক’-এর ব্যবহার জানবে না বা কাক চিনবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। এটা যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া গেছে ইরাকের মাটিতেই। ইরাকের ফারা নামক এক স্থানে খননের ফলে একটি সীলমোহর পাওয়া গিয়েছে। এই সীল-মোহরে একটি নৌকার ছবি আছে। এই নৌকার উর্ধ্বভাগে ‘দিশাকাক’-এর মতো একটি পাখির ছবি। এসব থেকে এটা স্পষ্টভাবেই বলা চলে যে, সেকালে সমুদ্রগামী বাণিজ্য তরী পরিচালনার ব্যাপারে দিশাকাক ব্যবহারের রীতি এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।
আর একটি কথা। বাবেরু জাতকে দেখতে পাই, এই উপমহাদেশের বাণিজ্য তরী সরাসরি বাবেরু অর্থাৎ ব্যাবিলনের ঘাটে গিয়ে ভিড়েছে। এমন ঘটনা সে কখনোই ঘটতে পারত না, এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এ পর্যন্ত মেসোপোটেমিয়ার প্রাপ্ত কাহিনি, দলিলপত্র ইত্যাদি থেকে একটা জিনিস পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, ‘তিলমুন’ দ্বীপ ছিল অন্তর্বর্তী বাণিজ্য কেন্দ্র। এই তিলমুন দ্বীপ বর্তমানের পারস্য উপসাগরের অন্তর্গত বাহেরিন দ্বীপ। আমাদের এই উপমহাদেশের ও মেসোপোটেমিয়ার বাণিজ্য তরী এ দ্বীপে এসে ভিড়তো এবং এখানেই বাণিজ্য-পণ্যের আদান-প্রদান হতো। এই তিলমুন-এ ‘আলিফ তিলমুন’ নামে এক শ্রেণীর বণিক ছিল। এটি ছিল বণিকদের একটি গিল্ড। এদের মাধ্যমেই বাণিজ্যের পণ্য বিনিময়ের কাজ পরিচালিত হতো। তিলমুন
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments